ছিনতাই!

নষ্ট মোবাইল, নষ্ট ঘড়ি, নষ্ট ল্যাপটপ, নষ্ট আইপিএস, নষ্ট টিভি বেঁচতে পারেন। নষ্ট মোবাইল, নষ্ট ঘড়ি, নষ্ট বলতে বলতে বেসুরে উচ্চস্বরে মাঝবয়সী গলি দিয়ে হেঁটে যায়। মধ্যবিত্ব- নিম্ন মধ্যবিত্বের বাসার গলিতে সকাল থেকেই বিভিন্ন চলমান ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁটাচলা দেখা যায়। প্রতিদিনের এসব রুটিন চিত্রে ঘুম ভাঙে মায়াবতীর। ঘুমের অপূর্ণতায় এসব অভ্যাসে নিয়ে কোলবালিশকে আরো আপন করে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। মানুষের আবেগ অনুভূতির মিছে সান্ত্বনায় আনন্দ দেয় কোলবালিশ। কোলবালিশ নিয়ে মায়াবতীর একটি কবিতাও আছে। বাবা স্কুল শিক্ষক হওয়াতে পড়াশোনার পাশাপাশি সঠিক দিকনির্দেশনায় বই পড়ার অভ্যাস রয়েছেন। বর্তমানে মায়াবতী শিক্ষকতা করছেন একটি সরকারি মহিলা কলেজে। শিল্প-সাহিত্যমনা হওয়াতে ছাত্রী শিক্ষক সবার কাছে চরম জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথের গান এতোটাই চমৎকার গায় যে কলেজে সবাই মায়ারবীন্দ্র (রবী ঠাকুরের ছোট বৌ) বলে পরিচিত। গতরাতে একটি পড়া শেষ করতে হবে বলে রাত জাগতে হয়েছে। ঘুম পরিপূর্ণ হয়নি। ইদানীং জলবায়ু পরিবেশ প্রকৃতির পড়াশোনা বেশি করছেন। নষ্ট মোবাইল ক্রেতা গলির মাথা ঘুরে এদিকে আবার আসছে। ধীরে ধীরে বাতাসে কন্ঠের কম্পনের ওয়েব গুলো ভারী হয়ে ১৪৩ নাম্বার বাড়ীর দিকে আসছে। বিপরীত থেকে আসা মুরগী ওয়ালাও থেমে নেই। ঐ মুরগী… ঐ মুরগী…। নষ্ট মোবাইল…. ঐ মুরগী… রাখবেননিগো….. আছেনিগো… কিনবেননি…. বেঁচবেননিগো…. দিবেননিগো শব্দের ওয়েবগুলো তালে বেতালে এভাবেই কান্না করে যায় ব্যক্তি থেকে সারা পৃথিবী।

এই সংসারে আইসাই আমার অশান্তি। না পাইলাম জামাইর সুখ। না পাইলাম পোলাপান এর সুখ। সারাটাদিন মোবাইল মোবাইল। আমরা লেখাপড়া করি নাই। নতুন নতুন নিয়ম। এগুলো শৈল্পিক বাটপার। হাফিজ সাহেবের ঘরে এসব দুঃখবাণীও নিয়মিত প্রচারিত হয়। বাঙালি সমাজে নারীদের কমন দুঃখ এগুলো। হাফিজ – রাজিয়ার ছোট ছেলে শ্রেষ্ঠ এবার এসএসসি দিলো। বড় মেয়ে স্মৃতি স্বামীর সাথে কলকাতা থাকেন। মায়াবতী, স্মৃতি, ও শ্রেষ্ঠ। এই তিন সন্তান নিয়ে মিরপুরে থাকেন। নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে একটি চারতলা বাড়ির ফাউন্ডেশনে এক তলা প্রস্তুতে তিন ইউনিটের একটিতে থাকেন। হাফিজ উদ্দিন তিনদিন হলো গ্রামের বাড়িতে গেলো। গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে বাকী বাড়ি সম্পূর্ণ করবেন। মায়াবতীকে ধুমধাম করে বিবাহ দিবেন। রাজিয়া প্রতিদিনের রুটিন চিৎকার করছে আর রুটি ছেঁকছে। গৃহকর্মী রুমানা রুটি বেলে দিচ্ছে। মায়াবতীদের এসব সহ্য হয়ে গেছে। মায়েদের এসব দুঃখ স্বামী সন্তানের প্রতি মায়া বাড়ায়। এসব একজন নারীর দায়িত্বের বিশাল গুণ। তাইতো সৃষ্টিকর্তা নারীকেই মা হওয়ার সৌন্দর্য দিয়েছেন। মায়াবতী রিহার্সালে যাবে। আগামী শুক্রবার নূর ক্রিয়েশনস আয়োজিত কলেজ শিক্ষকদের অংশগ্রহণে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে গান করবেন। মা নাস্তা হইছে.? রুমানা মায়াবতীরে নাস্তা দিয়া আয়। মোবাইল খেলোয়াড়কে জিগা ডিম ক্যামনে খাইবো.? আর সহ্য হয় না এতো যন্ত্রণা। রুমানা ফ্রিজ থেকে ডিম দে….

দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে রাস্তায় বাসের অপেক্ষার চেয়ে জলের জন্য চাতকেরও এতো সময় অপেক্ষা করতে হয় না। রাস্তা, গাড়ী, নিয়ম প্রয়োগের চেয়ে যাত্রী বেশি। স্ব স্ব দায়িত্বহীনতায় কুশিক্ষায় ভরপুর। সবাই কেমন যেনো অস্থির। দূর্ভোগকে সঙ্গী করে পথ চলে। অনেকক্ষণ পর শিকড় পরিবহনের একটি বাস আসে। মহিলা সিট খালি থাকাতে ভাগ্যক্রমে মায়াবতী জানালার পাশে কানে এয়ারফোন দিয়ে শুনছে… ‘ আমারে দিয়া দিলাম তোমারে! তুমি কি দিবা তোমায় আমারে.? ‘। জ্যাম আর রাস্তা খোড়াখুড়ির রাজত্বে যায় আবার যায় না ফিলে এগিয়ে চলছে শহরের ব্যস্ত যাত্রীদের নামেমাত্র সিটিং পরিবহন।

মিরপুর থেকে শাহবাগ মতিঝিল রুটে আসতে দশ নাম্বার, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, ফার্মগেট, কাওরানবাজার জ্যামে না পড়লে মনেই হয় না মিরপুর থেকে কেউ আসলো। এসব জায়গায় জ্যামের সাথে সময়ের ভীষণ প্রেম। কাঁঠালের আঠার চেয়েও আঠালো প্রেম। ছাড়েও ছাড়েনা। ধরেও ছাড়েনা। বিরক্ত মেজাজে গানও ভালো লাগেনা। এয়ারফোন খুলে ব্যাগে রাখে। বহু জ্যামে ত্যক্তবিরক্ত মায়াবতী চোখ বন্ধ করে ভাবছে। কি ভাবছে.?
রাজধানীর প্রায় সকল পাবলিক পরিবহনেই হকার হিজরাদের উপদ্রব দেখা যায়। হিজরা সম্প্রদায়ের সাথে তথাকথিত সমাজের বৈষম্য থাকার কারনে তারা অবহেলিত। তাদের আচরণে বহুজন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে। সঠিক ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে হিজরাদের ও দেশের সম্পদ করা যায়। এগুলো দেখে আর ভাবে। না কি অন্য কিছু ভাবে মায়াবতী.?

আমার জিনিস! আমার জিনিস! ঐ…. ঐ!!!

আর কিছু বলতে পারছে না মায়াবতী।৷ বাস ফার্মগেট কাওরানবাজার জ্যমে। এখানে প্রায় প্রতিদিনই অন্য জায়গার মতো ছিনতাই হয়। তবে এই এলাকায় একটু বেশিই হয়। কান ছিড়ে রক্ত পড়ছে। প্রচুর রক্ত। ডান কাধ বেয়ে ঝরছে। সাদা জামা রক্তে লাল রঙ ধারন করছে। বাসের যাত্রী কেউ উৎসুক। কেউ সমব্যথী। কেউ রক্তের চলমানতা ভয় পায়। কেউ ছিনতাইকারীর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। কেউ সরকারকে ছিন্নমূল সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের কর্মসংস্থানের জন্য দোষ দিচ্ছে। যাচ্ছে তাই বলছে। জনগণ সুযোগ পেলেই বলতে চায়। নিয়ম অনিয়ম নিয়ে ডক্টরেট করা বরং নিজে সচেতন হতে চায় না। দায়িত্বের সঠিক ব্যবহার করেনা। মায়াবতী সেন্সলেস। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। পাশের সিটের ভদ্রমহিলা যাত্রীরা মায়াবতীর চোখেমুখে পানি দেয়। কাছের কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবে হয়তো!

হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে জ্ঞান ফিরে মায়াবতীর। প্রচুর রক্তক্ষরনে শরীর দূর্বল। কানে সেলাই ব্যান্ডেজ নিয়ে বেশ কিছু দিন রেস্টে থাকতে হবে। পাশের সিটের ভদ্রমহিলা এতোক্ষণ সাথে থেকে মায়াবতীকে বাসায় পৌঁছে দিতে চায়। না না পৌঁছাতে হবে না। আমি বাসায় ফোন দিচ্ছি এসে নিয়ে যাবে। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এ অসভ্য ক্ষুদার্ত সমাজে কেউ কাউকে রাস্তায় এতো উপকার করে না। কৃতজ্ঞতাবোধ স্বীকার করতেই মায়াবতীর চোখ যায় হাসপাতালের রিসিপশনের ৫৬” এলইডি টেলিভিশনে। ব্রেকিং স্ক্রল চলছে…*** পরিকল্পনা মন্ত্রীর আইফোন ছিনতাই

লেখক : মুরাদ নূর।
সুরকার ও সংস্কৃতি কর্মী