প্রশিক্ষণ, লাইসেন্স, বয়স- স্পিডবোট চালাতে লাগে না কিছুই !

দীর্ঘদিন ধরেই মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথে স্পিডবোট চালান হালিপ মিয়া (২৬)। মুঠোফোনে আলাপকালে তিনি বলেন, আমরা কোনো প্রশিক্ষণ পাইনি। তবে অভিজ্ঞ চালকের সঙ্গে চার-পাঁচ দিন থাকলেই বোট চালানো শেখা যায়। তবে ফুল লোড নিয়ে বোট চালাতে হলে খুব সর্তক হতে হয় জানিয়ে এই চালক বললেন, এখানে অনেক চালক, সবাই তো আর সর্তক নন। কারও কারও বয়স কম, ইচ্ছেমতো চালায়।

মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার নৌপথে লঞ্চ ও ফেরির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যাত্রী বহন করে প্রায় আড়াই শ স্পিডবোট। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চলাচলরত এসব স্পিডবোটের চালকদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এমনকি চালকদের বড় একটি অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক। অবৈধ স্পিডবোট, অদক্ষ চালকের কারণে এই নৌপথে ঘটছে দুর্ঘটনা। নৌযানগুলোতে লাইফ জ্যাকেটের মতো সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনায় প্রাণহানিও বেশি।

এদিকে এই নৌপথে চলাচলরত ৫০টির মতো স্পিডবোট বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক লাইসেন্স নিয়েছে। যে কটির লাইসেন্স আছে, তারও আবার নবায়ন নেই। ফলে চলাচলরত স্পিডবোটগুলোর সব কটি অবৈধ।
এ সম্পর্কে বাংলাবাজার ঘাটের ট্রাফিক পরিদর্শক আক্তার হোসেন বলেন, উভয় ঘাটে আড়াই শ স্পিডবোট চলে, যার একটিরও লাইসেন্স বা কোনো কাগজপত্র নেই। এরপরও প্রতিবছর মন্ত্রণালয় থেকে ইজারা হয়। কিন্তু কেন হয়, তা বলতে পারবেন না তিনি। তিনি আরও বলেন, স্পিডবোট লাইসেন্সের জন্য আমরা স্পিডবোট মালিকপক্ষকেও চাপ দিয়েছি। আশা করছি, শিগগিরই লাইসেন্স হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বাংলাবাজার কাঠালবাড়ি ঘাট সূত্র জানায়, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাতায়াতের জন্য অন্যতম শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথ। এই নৌপথ দিয়ে দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার মানুষ যাতায়াত করে। যাত্রীদের বড় একটি অংশ পারাপার হয় স্পিডবোটে। বর্তমানে এই নৌপথে প্রায় ২৫০টি স্পিডবোট চলাচল করে। এ ছাড়া ফেরি, লঞ্চ ও ট্রলারেও যাত্রী পারাপার হয়। যদিও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে লকডাউন থাকায় এই নৌপথে ফেরি ছাড়া সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে লঞ্চগুলো সেই নিয়ম মেনে চললেও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই অবাধে চলাচল করে স্পিডবোট।

স্পিডবোট চালক শাহিন মিয়া বলেন, আমি ৬ বছর ধরে স্পিডবোট চালাই। উভয় ঘাটে নতুন কিছু ২০০ সিসির বোট নামানো হয়েছে। এগুলোর চালকের বয়স বেশির ভাগই ১৮ এর নিচে। ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে অন্তত ৩০ জন আছে, যারা খুব তাড়াহুড়া করে বোট চালায়। এদের কারণে আজ সব চালকের সমস্যা।

ইমরান মিয়া নামের এক তরণ চালক বলেন, কাউন্টার থেকে আমাদের যতজন নিতে বলে, আমরা ততজনই নিই। এখানে আমাদের লাভ কম। কাউন্টারে যারা থেকে নেতৃত্ব দেয়, তারাই সব ম্যানেজ করে চালায়।

স্পিডবোটের মালিকেরা বলছেন, আরও এক বছর আগেই স্পিডবোটের লাইসেন্সের জন্য বিআইডব্লিউটিএর বন্দর বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মালিকদের লাইসেন্স দিচ্ছে না। নানা অজুহাতে লাইসেন্স বাতিলও করে দিচ্ছে। স্পিডবোটের চালকদের প্রশিক্ষণের জন্য নামের তালিকা দিলেও প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

বাংলাবাজার স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি ও পাঁচ্চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, আমাদের পারে ১০টি স্পিডবোটের লাইসেন্স আরও দেড় বছর আগে দিছে বিআইডব্লিউটিএ। এরপর এক বছর আগে ৩৯ টি বোটের লাইসেন্সের জন্য কাগজপত্র ও তালিকা নেয়। চালকের প্রশিক্ষণের জন্য নামের তালিকা নেয়। কিন্তু লাইসেন্সও দেয় না আর চালকদের প্রশিক্ষণও দেয় না।
তিনি আরোও বলেন, শিমুলিয়া ঘাটের স্পিডবোটগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তারা লকডাউনের মধ্যে ছাড়ে। তবে বাংলাবাজার ঘাটে তারা আসতে পারে না। তারা চরে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। সোমবারের দুর্ঘটনাটিও চরে যাত্রী নামাতে গিয়ে বাল্কহেডের পেছনে ধাক্কা লাগিয়ে দেয় স্পিডবোটের চালক।

বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, প্রায় ৫০টি স্পিডবোটের লাইসেন্স নেওয়া। তবে এগুলোর হয়তো নবায়ন নেই। এখানে আমাদের লাইসেন্স দিতে কোনো সমস্যা নেই। মালিকপক্ষ কখনো আমাদের কাছে আসছে, কখনো আসেনি। সবার মধ্যে একটি সমন্বয়হীনতা ছিল। এরপরও আমরা অতিদ্রুত স্পিডবোটগুলো লাইসেন্সসহ চলাচলে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব।

বাংলাবাজার ঘাটের দায়িত্বরত চরজানাজাত নৌ পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আবদুল রাজ্জাক বলেন, লকডাউন কার্যত থাকার পরও কিছু বোট চুরিচামারি করে চলে। এগুলোয় লাইফ জ্যাকেটও ব্যবহার করা হয় না। সোমবারের দুর্ঘটনায় কোনো যাত্রীর সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট ছিল না। দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মুমূর্ষু হয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছেন। লাইফ জ্যাকেট থাকলে অনেকেই বেঁচে যেত।