পুলিশ ফাড়িতে রায়হান হত্যায় এসআই আকবরসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল

সিলেটের বহুল আলোচিত বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতনে নিহত রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানার বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

বুধবার (৫ মে) সকাল ১১টায় পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে সিলেটের আলোচিত এই হত্যা মামলাটির অভিযোগপত্রটি দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ উজ জামান জানান পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কর্মকর্তারা মামলাটি ভার্চুয়াল আদালতে উপস্থাপন করবেন।

চার্জশিটে অভিযুক্তরা হলেন, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির বরখাস্তকৃত ইনচার্জ পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আকবর হোসেন ভূঁইয়া, সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) আশেকে এলাহি, হাসান উদ্দিন, পুলিশের কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, টিটু চন্দ্র দাস এবং সাংবাদিক আব্দুল্লাহ আল নোমান।
নগরের আখালিয়া নিহারিপাড়ার বাসিন্দা রায়হানকে ১০ অক্টোবর রাতে সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কাষ্টঘর সুইপার কলোনি থেকে তাকে ফাঁড়িতে তুলে নিয়ে যান এই ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ও তার সহকারীরা। এরপর কয়েক ঘণ্টা চলে নির্যাতন।

শেষ রাতে এক পুলিশ সদস্যের মোবাইল থেকে নিজের চাচাকে ফোন করে রায়হান। এসময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে দ্রুত ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে আসার জন্য চাচাকে অনুরোধ করে। ভোরের ফজরের নামাজের পূর্ব মুহূর্তে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে হাজির হন চাচা। তবে তখন তাকে রায়হানের সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এরপর ১১ অক্টোবর সকালে আবার চাচা ফাঁড়িতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ায় রায়হানকে ওসমানী হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। পরে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে রায়হানের মরদেহ দেখতে পায় পরিবার।

এদিকে রায়হানের মৃত্যু জানাজানি হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, কাষ্টঘর এলাকায় ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে মারা গেছেন রায়হান। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালের মর্গে প্রেরণ করেছে। বন্দর বাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা ও সিলেট মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সকাল থেকে গণমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশ হয়।

পরিবার ও এলাকাবাসীর বিক্ষোভ: নগরীতে গণপিটুনিতে ছিনতাইকারীর মৃত্যু- বিভিন্ন গণমাধ্যমে যখন এমন খবর প্রকাশ হচ্ছিলো, তখন ভিন্ন তথ্য নিয়ে সামনে আসে নিহত যুবক রায়হান আহমদের পরিবার ও আখালিয়া এলাকাবাসী।

রায়হানের বাসার সামনে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে তারা জানান, ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে টাকার জন্য নির্যাতন চালিয়ে রায়হানকে হত্যা করেছে পুলিশ।

পরিবারের এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ হয়। এতে পর নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসন। আর পরিবার ও এলাকাবাসীর মাধ্যমে শুরু হওয়া রায়হান হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিলেটজুড়ে।

পুলিশের উদ্যোগ: ফাঁড়িতে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর মহানগর পুলিশের পক্ষে থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৪ পুলিশ সদস্যকে ১২ অক্টোবর সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এর আগে ১১ অক্টোবর রাতেই হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। এরপর আরও চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

তদন্তে পিবিআই, আকবর পলাতক: পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ ওঠার পর কোতোয়ালি থানা থেকে এই মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)কে। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই তারা রায়হানের মরদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় ময়না তদন্তের উদ্যোগ নেয়। দুই ময়না তদন্ত রিপোর্টেই রায়হানের শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।

এরপর পিবিআই বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তার করে বন্দরবাজার ফাঁড়ির কর্মকর্তা এসআই হাসান আলী, এএসআই আশেকে এলাহি, কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস। এদের সকলকেই আগে বহিষ্কার করে সিলেট মহানগর পুলিশ।

এদিকে, সাময়িক বহিষ্কার হওয়ার পর পুলিশ, লাইনে সংযুক্ত থাকা অবস্থায় পালিয়ে যান বন্দরবাজার ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ এসআই (বহিষ্কৃত) আকবর হোসেন ভূঁইয়া। তিনি ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যান বলে অভিযোগ ওঠে।

নানা সমালোচনা ও তীব্র আন্দোলনের মুখে গতবছরের ৯ নভেম্বর কানাইঘাট সীমান্ত থেকে আকবরকে গ্রেপ্তার করে সিলেট জেলা পুলিশ। ভারতে পালানোর সময় সাদা পোশাকের পুলিশ তাকে আটক করে বলে সেসময় জানিয়েছিলেন সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন।

ভারতের সীমান্তের ভেতরে স্থানীয় খাসিয়ারা আকবরকে আটক করে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে এসে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। আকবরকে কানাইঘাট সীমান্তের ওপারে ভারতের একটি খাসিয়া পল্লীতে আটকের একটি ভিডিও ফেসবুকেও ছড়িয়ে পড়ে।

আকবরকে গ্রেপ্তারের পরদিন ১০ নভেম্বর তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই। এরআগে এই ঘটনায় গ্রেপ্তার অন্য পুলিশ সদস্যদেরও রিমান্ডে নেওয়া হয়। তবে রিমান্ড শেষে তারা কেউই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেননি।

অবশেষে অভিযোগপত্র: মামলার তদন্তকাজে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে বারবার প্রশ্নের মুখে পড়ে পিবিআই। তদন্তকারী সংস্থাটির পক্ষ থেকে একাধিকবার অভিযোগপত্র প্রদানের ঘোষণা দিয়েও পরে তা দেওয়া হয়নি। এনিয়ে ক্ষোভ দেখা দেয় রায়হানের পরিবারে। অবশেষে হত্যাকাণ্ডের প্রায় সাত মাস পর আজ এই হত্যা মামলার অভিযোগপত্র পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার কাছে মামলাটির অভিযোগপত্রটি দাখিল করে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিবিআই সিলেটের পুলিশ সুপার খালেদ-উজ জামান বলছেন, অভিযোগপত্রটিতে যাতে কোনো খুঁত না থাকে, যাতে তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে এজন্য তদন্তে সবগুলো দিক খতিয়ে দেখা হয়েছে। এ কারণে কিছুটা সময় লেগেছে।

তিনি বলেন, আলোচিত এ মামলাটির আসামি পুলিশ হওয়ায় একটি নির্ভুল, ত্রুটিমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য চার্জশীট তৈরি করতে কিছুটা সময় লেগেছে। এছাড়া করোনার বিরূপ পরিস্থিতির কারণেও কিছুটা দেরী হয়েছে।