নগর হোক শিশুদেরও

যখন নগর পরিকল্পনা করা হয়, তখন শিশুরা সম্ভবত সবচেয়ে কম প্রাধান্য পায় অথবা হয়তো একেবারেই তাদের বিবেচনা করা হয় না। বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন প্রায় ৫০০ শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে এবং হাজার হাজার শিশু আহত হয়। তাছাড়া দুর্ঘটনার কারণে তারা যে মানসিক আঘাত পায়, তা থেকে মুক্তি পেতে তাদের বছরের পর বছর চলে যায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে বাংলাদেশে ৫৪৯ জন শিশু সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেছে। সড়কই হোক বা অন্য যেকোন গণপরিসরই হোক শিশুরা যদি অনিরাপদ অনুভব করে, তারা যদি স্বচ্ছন্দ না হয় তাহলে তারা বাইরে খেলাধূলায় আগ্রহী হয় না। সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, অনুপযোগী পরিবেশ ইত্যাদির ফলে ১১-১৭ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশু শারীরিক কার্যক্রমে সক্রিয় নয়। বাংলাদেশেও শিশুদের মধ্যে স্থ‚লতার সমস্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম একটি কারণ হলো শিশুদের মধ্যে শারীরিক কার্যক্রমের পরিমাণ অর্থাৎ খেলাধূলা, সাইকেল চালানো বা হাঁটা ইত্যাদির পরিমাণ অত্যন্ত কম।

করোনাভাইরাস অতিমারী আমাদের আরো পরিষ্কার করে একটি শিশুবান্ধব নগরীর প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দিয়েছে। একটা দীর্ঘ সময় শিশুরা ঘরে আটকে থাকার ফলে তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিদ্যালয় আমাদের দেশের বিশেষত নগর অঞ্চলের অনেক শিশুর জন্যই একটু নিশ্বাস নেবার জায়গা। সেই স্কুলও বন্ধ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। ফলে খেলাধূলা-সামাজিকীকরণ কোনটিরই সুযোগ না থাকায় তারা দমবন্ধ একটি পরিবেশে রয়েছে।

আমাদের প্রত্যেকের মনেই এখন একটি প্রশ্ন রয়েছে বা বলা যায় একটি উদ্বেগ রয়েছে কোভিড পরবর্তী শহর কেমন হবে। এক্ষেত্রে একটি কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। কোভিড-এর সময় আমরা আমাদের অনেক ভ‚ল-ভ্রান্তি বুঝতে পেরেছি। এ ভ‚লগুলো শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। এমনই একটি ভ‚ল হলো নগর তৈরির ক্ষেত্রে শিশুদের প্রাধান্য না দেয়া। কাজেই কোভিড পরবর্তী সময়ে বা কোভিড রেসপন্স হিসেবে নগর এলাকাগুলোতে শিশুদের প্রয়োজনীয়তাকে বা শিশুবান্ধব নগরী গড়ে তোলার বিষয়টি বিবেচনা করা অতি আবশ্যক।

প্রশ্ন হলো- শিশুবান্ধব নগরী বলতে কি বোঝায়? শিশুদের শারীরিক কার্যক্রম ও খেলাধূলার জন্য খেলার মাঠই কি যথেষ্ট? অবশ্যই খেলার মাঠ-পার্ক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কিন্তু এর সাথে সাথে আরো কিছু বিষয় নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

সবুজায়ন: দুচোখ ভরে সবুজ এলাকা দেখতে কার না ভালো লাগে! সবুজ গাছপালা-ফুলের সমারোহ দেখলে মনটা যেন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। শিশুদেরও কিন্তু তাই। সবুজ উদ্যানে যদি তারা সহজে বেড়াতে যেতে পারে তাহলে তাদের মানসিক চাপ কমে যায়, তারা মনোযোগী হয়ে ওঠে। আবার সবুজ উদ্যানে গিয়ে তারা ইচ্ছেমতো ছুটোছুটি করে খেলাধূলা করতে পারে বলে তাদের স্থ‚লতার আশঙ্কাও কমে যায়। সবুজ উদ্যান কিন্তু নগরীর বাতাসের মানও ভালো রাখে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে বায়ুর মান এতটাই খারাপ হয়ে গেছে যে, আজকে যারা শিশু তাদের কাছে পরিষ্কার বাতাস অনেকটা স্বপ্নের মতো। কাজেই একটি শিশুবান্ধব শহরে অবশ্যই পর্যাপ্ত সবুজ এলাকা থাকা চাই। দু:খজনক হলেও সত্যি যে ঢাকা শহরে সবুজের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ঢাকা শহরে আর মাত্র ২ শতাংশ সবুজ অবশিষ্ট আছে বলে পরিবেশবাদীদের মতামত। ঢাকা শহরে এখনো অনেক জায়গা রয়েছে যেগুলো খালি পড়ে রয়েছে আবার কিছু এলাকা একদমই পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে গাছ লাগানো, পাশাপাশি এলাকাবাসীর জন্য সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। তবে সবুজ এলাকা বা সামাজিকীকরণের স্থান থাকলেই হবে না, সে জায়গাগুলো যেন সকলের জন্য প্রবেশগম্য হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। এছাড়া দালানের ছাদেও নগরকৃষির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন খাদ্য চাহিদা পূরণ হবে তেমনি আরবান হিট আইল্যান্ড প্রভাবও কমে যাবে।

হাঁটা ও সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো: হাঁটা ও সাইকেলবান্ধব অবকাঠামো সকলকেই এ মাধ্যমগুলোতে যাতায়াতে উদ্বুদ্ধ করে তবে শিশুরা বেশি উপকৃত হয়। কারণ হাঁটা ও সাইকেল প্রধান যাতায়াত মাধ্যম হলে শিশুদের জন্য সড়কে যথেষ্ট জায়গা থাকে। তারা খেলাধূলা করতে পারে। আবার হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াত তাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপদ হয়। অনেক অভিভাবকই শিশুদের হাঁটা বা সাইকেল চালাতে দিতে ভয় পায়। কারণ রাস্তায় অত্যধিক ব্যক্তিগত গাড়ি-মোটরসাইকেল আর তাদের বেপরোয়া গতি। শিশুদের জন্য তাদের প্রতিদিনকার যে গন্তব্যগুলো রয়েছে, সেগুলোতে হেঁটে বা সাইকেলে যাতায়াত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। এতে যেমন তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য ভাল থাকবে তেমনি বন্ধুদের সাথে যাতায়াত করতে পারলে তাদের মনও ভাল থাকবে। শিশুদের একটা অন্যতম নিত্য যাওয়ার জায়গা হলো স্কুল। আমরা যদি ভেবে দেখি আগের দিনের স্কুলে যাতায়াতের বিষয়টি। দলবেঁধে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে, নানারকম খুনসুটি করতে করতে যাওয়ার আনন্দটাই ছিলো অন্যরকম। আর এখন শিশুরা গাড়ি করে স্কুলে যায় আর আসে। আর যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। তাদের শরীর-মন ভালো থাকবে কি করে?

ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট স্টাডি ২০১০ অনুযায়ী, ঢাকা শহরে ৩০ শতাংশ স্কুল ট্রিপ হয় হেঁটে এবং মাত্র ৪ শতাংশ স্কুল ট্রিপ হয় ব্যক্তিগত গাড়ির মাধ্যমে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক বেশি নয়। যদি ৪ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার এ পরিমাণ যানজট সৃষ্টি করতে পারে তাহলে সহজেই অনুমেয় যে, এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যানজট পরিস্থিতি কতটা তীব্রতর হবে। ঢাকা শহরে হাঁটার ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, যেমন- অপর্যাপ্ত ফুটপাত, অসমান এবং ভাঙ্গা ফুটপাত, অপর্যাপ্ত সমতলে পারাপার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এতদস্বত্বেও ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত করে। অতএব, ঢাকা শহরে যদি হাঁটা ও সাইকেলে যাতায়াতের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় তাহলে যেমন অনেক শিক্ষার্থী উপকৃত হবে তেমনি যারা অন্যান্য মাধ্যমে যাতায়াত করে তারা হেঁটে ও সাইকেলে যাতায়াতে উৎসাহী হবে।

গতি নিয়ন্ত্রণ: ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এর একটি জরিপ থেকে দেখা গেছে প্রায় ৭৭.৩৮ শতাংশ শিশু গাড়ির বেপরোয়া গতির কারণে হেঁটে যাতায়াতে আতঙ্কিতবোধ করে। গাড়ির গতি যত বেশি হয় ততটাই দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বাড়ে। কারণ গাড়ির গতি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি চালকের জন্য সড়কে কোন ছোট শিশুকে দেখতে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে গাড়ি গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে গাড়ির বেপরোয়া গতির কারণে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। এ অবস্থায় গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।

কারফ্রি স্ট্রীট আয়োজন: শহরে খেলা এবং বিনোদনের পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে শিশু-কিশোরদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে শিশুরা টিভিতে কার্টুন ও গেইমস এ আসক্ত হয়ে পড়ছে। প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধী মানুষের পাশাপাশি বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা বেশীর ভাগ সময় বাসায় বন্দীর মতই থাকছেন। সামাজিকীকরণের জন্য এলাকার অভ্যন্তরে কম ব্যস্ত সড়কে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে যানবাহন বন্ধ রেখে বা নিয়ন্ত্রণ করে শিশুদের খেলাধুলা, সাইক্লিং, স্কেটিংসহ সব বয়সের মানুষের বিনোদনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে এলাকাবাসীর শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকবে। যে এলাকা অনেক জনবহুল এবং বিনোদন বা সামাজিকীকরণের স্থান নেই কার ফ্রি স্ট্রীট সেখানে একটি যুগোপযোগী আয়োজন।

শুধু গাড়িমুক্ত সড়ক বা কারফ্রি স্ট্রীট আয়োজন নয়, পাশাপাশি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণেও উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একই সাথে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান আমরা পেয়ে যাবো। শব্দ ও বায়ুদূষণ কমে যাবে, দুর্ঘটনা, যানজট, জ্বালানি ব্যয়ও কমে যাবে। বর্তমানে বায়ুদূষণ আমাদের জন্য একটি অন্যতম হুমকি। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করে। বায়ুদূষণের কারণে ফুসফুস সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষকরা বলছেন, দুর্বল ফুসফুস কোভিড-এ আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর একটি বড় কারণ। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমরা কি রেখে যাচ্ছি? আমরা আমাদের অবিবেচক আচরণ দিয়ে আজকে পরিবেশের যে অবস্থা করেছি তার ফলাফল ভোগ করছে আজকের শিশুরা। ভবিষ্যতে যদি কোভিডের চেয়ে ভয়াবহ কোন অতিমারীর মুখোমুখি হতে হয় তাহলে বিশ্ববাসী কি ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে তা সহজেই অনুমেয়।

একটি শহর যদি শিশুবান্ধব হয় তাহলে শহরটি নিঃসন্দেহে সকলের জন্য একটি বসবাস উপযোগী শহর। বর্তমানে প্রতিটি সরকার কোভিড-পরবর্তী দেশ কেমন হবে সে বিষয়টি বিবেচনা করছে। কোভিড যেমনই আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ তেমনি সুযোগ। আমরা আমাদের শহরগুলোকে পুনরায় বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছি। আমরা যদি নগর পরিকল্পনায় শিশুদের প্রয়োজনীয়তাকে প্রাধান্য দেই নিঃসন্দেহে শহর হবে অন্তর্ভূক্তিমূলক ও বসবাসযোগ্য। কাজেই দীর্ঘমেয়াদে এমনভাবে নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেন শিশুসহ সকল নাগরিক উপকৃত হন।

লেখক : নাঈমা আকতার, উন্নয়ন কর্মী
যোগাযোগ: [email protected]