পুণ্যময় রজনী শবে বরাত

মহান সৃষ্টিকর্তা মানব জাতিকে সীমিত শক্তি ও ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণায়, নফসের তাড়নায় বিপথগামী ও পাপাচারী হয়। মানুষের পাপমোচনের জন্য সৃষ্টিকর্তা বিশেষ কিছু দিবস ও রজনী দিয়েছেন, তন্মধ্যে অন্যতম শবে বরাত। সৃষ্টিকর্তা বান্দার জন্য বিশেষ বরকত রেখেছেন এ পুণ্যময় রজনীতে। শা’বান মাস অধিক মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসকে রমজানের প্রস্তুতি মাস বলা হয়েছে।

‘শবে বরাত’ দু’টি ফারসি শব্দ। ‘শব’ অর্থ রাত বা রজনী। ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য। দু’টো একত্রিত করলে অর্থ দাঁড়ায় ভাগ্যের রজনী। শবে বরাতকে আরবীতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ অর্থাৎ মুক্তির রাত বলা হয়। কুরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ্’ অর্থাৎ বরকতময় রজনী বলা হয়েছে। হাদিসে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ অর্থাৎ শা’বানের মধ্যরজনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাফসীরের কিতাব, হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ও ফিকাহ গন্থসমূহে শবে বরাতের উল্লেখিত নাম ছাড়া আরো বিশেষ কিছু নাম এসেছে। যেমন- ভাগ্যের রাত, রিযিক বণ্টনের রাত, তাকদীর নির্ধারণের রাত, ক্ষমার রাত, দয়ার রাত, তাওবার রাত ও মিনতির রাত। এ রাতে গুনাহগারের গুনাহ মাফ হয় এবং অসংখ্য অপররাধীর অপরাধ ক্ষমা করা হয়, সেহেতু এ রাত মুসলমানদের মাঝে ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দিসহ নানান ভাষায় যা ‘শবে বরাত’ নামেই অধিক পরিচিত।

ইরশাদ হচ্ছে- ‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয় আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি। এ হলো আপনার প্রভুর দয়া, নিশ্চয় তিনি সব শোনেন ও সব জানেন। তিনি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এই উভয়ের মাঝে যা আছে সেসবের রব। যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করো, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি জীবন ও মৃত্যু দেন, তিনিই তোমাদের পরওয়ারদিগার আর তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও। তবুও তারা সংশয়ে রঙ্গ করে। তবে অপেক্ষা করো সেদিনের, যেদিন আকাশ সুস্পষ্টভাবে ধূম্রাচ্ছন্ন হবে। (সুরা-দুখান,আয়াত:১-১০)। মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুল মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শা’বান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)।

রাসুল (সা.)-এ মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোযা রাখতেন। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে রমজান মাস ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোযা রাখতে দেখিনি এবং শা’বান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোযা রাখতে দেখিনি। (বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন- ‘আল্লাহ শা’বানের মধ্যবর্তী রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন’। (ইবনে হিব্বান)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহ এ রাতে বিদ্বেষ পোষণকারী ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারী ছাড়া বাকি সব বান্দাকে ক্ষমা করে দেন’। (মুসনাদে আহমদ)। ‘যখন শা’বানের মধ্য রাত আসে, তখন আল্লাহ মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদিগকে ক্ষমা করে দেন, কাফিরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না’। (কিতাবুস সুন্নাহ)।

রাসুল (সা.)-এ রাতে মদিনায় ‘জান্নাতুল বাকি’তে এসে কবরবাসীদের জন্য দোয়া ও ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এ রাতে বনি কালবের ভেড়া-বকরির পশমের পরিমাণের চেয়ে বেশিসংখ্যক গুনাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন’। (তিরমিজি)। আয়েশা (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন- এক রাতে আমি রাসুল (সা.)-কে না পেয়ে তাঁর সন্ধানে বের হলাম। গিয়ে দেখলাম তিনি জান্নাতুল বাকি’তে অঝোর নয়নে কাঁদছেন। রাসুল (সা.) আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হে আয়েশা! ‘তুমি কি মনে কর, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর জুলুম করবেন?’ আমি বললাম হে আল্লাহ’র রাসুল (সা.)! না; আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি হয়ত অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। রাসুল (সা.) বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহ’র রাসুলই ভালো জানেন। তখন রাসুল (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শা’বানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন।

আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। (শুআবুল ইমান)। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন- ‘১৪ শা’বান দিবাগত রাত যখন আসে, তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত বন্দিগিতে কাটাও এবং দিনের বেলায় রোজা রাখো; আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন- যখন শা’বানের মধ্য রাতটি আসবে তখন তোমরা সে রাতে কিয়াম তথা রাতভর নামাজ পড়বে এবং পরদিন রোজা রাখবে। কেননা সেদিন সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন- আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী যাকে আমি ক্ষমা করব। আছে কি কেউ রিযিক প্রার্থনাকারী যাকে আমি রিযিক দিব। আছে কি কেউ সমস্যাগ্রস্ত যে আমার কাছে পরিত্রাণ চায়, আমি তাকে উদ্ধার করব। এভাবে আল্লাহ ফজর পর্যন্ত বান্দাহেক তাঁর কুদরতী জবান দ্বারা আহ্বান করেন। (ইবনে মাজাহ)। তবে দু’শ্রেণির লোককে তিনি ক্ষমা করেন না, যারা আল্লাহ’র সাথে শরীক করে, যারা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকে।

শা’বান মাস থেকেই রমজানের প্রস্তুতি। রমজানের পরেই শা’বান মাস ইবাদাতের উত্তম সময়। শা’বান মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ রোজা রাখলে আইয়ামে বিদের রোজার সঙ্গে শবে বরাতের রোজার পূণ্য হয়ে যাবে। এ ছাড়া মাসের শুরুতে, মাঝে ও শেষে রোজা রাখা ফজিলতপূর্ণ আমল। অধিক ইবাদাতের মাধ্যমে রমজানের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা এবং এই দোয়া করাও সুন্নাত, ‘হে আল্লাহ! রজব ও শা’বান মাসে আমাদের বরকত দান করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকি)।

শবে বরাতের বিশেষ আমল হলো নফল নামাজ, তাহিয়্যাতুল অজু, দুখুলিল মাসজিদ, আউওয়াবিন, তাহাজ্জুদ, ছলাতুত তাসবিহ, তাওবার নামাজ, ছলাতুল হাজাত, ছলাতুশ শোকর ও অন্যান্য নফল ইত্যাদি পড়া। নামাজে কিরাআত ও রুকু-সেজদা দীর্ঘ করা। পরের দিন নফল রোজা রাখা; কোরআন তিলাওয়াত করা; দরূদ শরিফ বেশি বেশি পড়া; তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা; দোয়া-কালাম, তাসবিহ তাহলিল, জিকির-আসকার ইত্যাদি করা; কবর জিয়ারত করা; নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সকল মোমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করা।

লেখক: মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
ম্যানেজার, (মুদ্রণ বিভাগ)