হাবিপ্রবিতে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ, ১৫ মার্চ তদন্তে যাচ্ছে ইউজিসির দল

দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে। সোমবার ১৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সরেজমিন তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপপরিচালক ও সংশ্নিষ্ট তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব আমিরুল ইসলাম শেখ এক পত্রের মাধ্যমে বিষয়টি অবগত করেছেন। ৮ মার্চ ইউজিসির ৩৭.০১.০০০০.১৫১.২২.০০১.২১.১৮/ ১৩৪৬নং স্মারকে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বরাবর একটি পত্রে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত পরিচালনা করবেন ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, অধ্যাপক ড. আবু তাহের ও আমিরুল ইসলাম শেখ।

পত্রে জানানো হয়, ‘কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটি আগামী ১৫ মার্চ সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীরে উপস্থিত থেকে তদন্তকাজ পরিচালনা করবে। ওই তারিখ ও সময়ে দালিলিক প্রমাণাদিসহ প্রক্টরের দায়িত্বসহ ভর্তি পরীক্ষা ২০১৮-এর সহযোগী সদস্য সচিব খালেদ হোসেন, উদ্যান তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. তরিকুল ইসলাম, জেনেটিক্স অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিংয়ের চেয়ারম্যান ড. আবদুল গাফফার, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (আইআরটি) পরিচালক অধ্যাপক ড. তরিকুল ইসলাম, ড. বিধান চন্দ্র হালদার ও ড. শ্রীপতি শিকদার, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং প্ল্যানিং ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহিমা খানম, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. ফজলুল হক, কন্ট্রোলার অধ্যাপক মিজানুর রহমান, প্রকৌশল শাখার চাঁদ আলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল) আবদুর রাজ্জাক, নির্বাহী প্রকৌশলী এবং পরিবহন শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল ওয়াহেদকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।

২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজ্জাদুল করিম নামে এক ব্যক্তি দুর্নীতি দমন কমিশন দিনাজপুরের উপপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেন (অভিযোগ নং-৪০৮/২০১৯)। পরে অভিযোগটি দুদক দিনাজপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয় ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। প্রাপ্ত অভিযোগের বিষয় তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানোর জন্য কমিশন সিদ্ধান্ত নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট পাঁচ পাতার অভিযোগের ছায়ালিপিসহ ইউজিসির চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দেন দুদকের পরিচালক ও অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য জহিরুল ইসলাম। দুদকে পাঠানো অভিযোগপত্রে নিয়োগে অনিয়ম, আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ ৩০টিরও বেশি অনিয়মের কথা বলা হয়ছে।

শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম : ‘উপাচার্যের পছন্দমতো নিয়োগ দিতে প্রচলিত বিধি ভেঙে শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের প্রতিনিধি পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচজনের অধিক জামায়াত-বিএনপির শিক্ষক রয়েছেন। নিয়োগ বোর্ডের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে হর্টিকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান লিখিত নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছেন। ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স বিভাগে প্রথম হওয়া প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অন্য প্রার্থীকে নিয়োগে সুপারিশ করা হয়েছিল। ভিসির ক্যাডার ছাত্র হত্যা মামলার আসামি রুহুল কুদ্দুস জোহার স্ত্রী তানজিনা শাহনাজ তুরিনকে জেনেটিক্স অ্যান্ড প্ল্যান ব্রিডিং বিভাগে, তৎকালীন অ্যাডভাইজারের ভাগ্নি তারা নুর ইসলামকে প্রভাষক পদে নিয়োগ দেন।

কর্মকর্তা নিয়োগে অনিয়ম : সার্কুলার ছিল ১৬ জনের। সার্কুলারে পদসংখ্যা বাড়ানো কিংবা কমানের শর্ত ছিল না। তথাপি ২২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন পদে একজন প্রার্থীর পাঁচটি পদে আবেদনের সুযোগ ছিল, প্রতিটি পদে আলাদা ব্যাংক ড্রাফট দিয়েছেন। উপাচার্য প্রার্থীকে আলাদা আলাদা প্রবেশপত্র প্রদান করেন। তবে একটি মাত্র লিখিত পরীক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং একটি খাতায় পাঁচটি রোল নাম্বার লেখার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়নি।

র্মচারী নিয়োগে অনিয়ম : কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ওয়েবসাইটে প্রকাশের কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। ফলে অনেক আবেদনকারী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি। সার্কুলারে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ভিসির ক্যাডার হিসেবে পরিচিত কৃষি অনুষদের ছাত্র রিয়াদ খানের ভাইকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আর্থিক অনিয়ম ও দূর্নীতি : ২০১৮ সালের ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। ওই ভর্তি পরীক্ষায় আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তৎকালীন উপাচার্য নিজে ভর্তি পরীক্ষার সম্মানী হিসেবে বেআইনিভাবে সাত লাখ টাকা নিয়েছেন। প্রক্টর খালেদ হোসেন ভর্তি পরীক্ষায় সহযোগী সদস্য সচিব হিসেবে গোপনীয় কার্যক্রমে জড়িত থাকলেও ভর্তি পরীক্ষার প্লাজমিড প্লাস নামে বিশেষ গাইড ও বিশেষ সাজেশন পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যা বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই গাইড থেকে বিভিন্ন ইউনিটে প্রায় ৬০-৭০টি প্রশ্ন কমন পড়েছিল। এত কিছুর পরও ২০২০ সালের ভর্তি পরীক্ষায় তাকে সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উদ্যান তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. তরিকুল ইসলামের আপন ভাতিজা ভর্তি পরীক্ষায় ২০১৯ সালে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও তিনি ওই ভর্তি পরীক্ষার সহযোগী সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের অনিয়ম ও দূর্নীতি : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. বিধান চন্দ্র হালদারের স্ত্রী ও এক সন্তান দীর্ঘদিন ভারতে অবস্থান করছেন। তার একমাত্র সন্তান তীর্থ হালদার বাংলাদেশ সরকারের কাছে স্টাডি পারমিশন না নিয়েই ভারতের আদিত্য একাডেমিতে পড়াশোনা করছেন। আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাসহায়ক ভাতা গ্রহণ করছেন, যা অবৈধ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ও প্ল্যানিং এবং উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক মোস্তাফিজার রহমান সাভারের গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্স বিভাগের ডিনের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন অপকর্মের সহযোগিতা করায় শিক্ষাজীবনে দ্বিতীয় শ্রেণি হওয়া সত্ত্বেও ড. ফাহিমা খানমকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট অনুষদের ডিন, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ও রোভার স্কাউটের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ডা. ফজুলল হক ভেটেরিনারি কলেজ দিনাজপুরে প্রেষণে কর্মরত থাকাকালে ভেটেরিনারি কলেজটি হাবিপ্রবিতে অধিভুক্ত হয়। ডা. ফজলুল হক তৎকালীন কমিটির কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে হাবিপ্রবির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৭ সালে ডা. ফজলুল হক দ্বিতীয় গ্রেডে উন্নীত হওয়ার আবেদন করলে তার গোপন তথ্য ও মিথ্যা তথ্য প্রদানের বিষয়টি ধরা পড়ে। সংশ্নিষ্ট কমিটি তার দূর্নীতির বিষয়ে শোকজ করেন। এর পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. ফজলুল হক বলেন, আগামী ১৫ তারিখে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি পরিদর্শনে আসবে। এক দিনের তদন্ত করেই তারা ফিরে যাবেন। যেসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত করা হচ্ছে সেসব সত্য নয়, বেশিরভাগই মিথ্যা। এর পরও আমরা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যাবতীয় কাগজপত্র দাখিল করব।

মার্চ ১৩, ২০২১ at১৬:২৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/পিআরজে/এমআরএইস