৭ই মার্চের ভাষণটি দশ মাসের বেশী সময় একটি ট্রাঙ্কে বন্ধি ছিল

রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সরোয়ারদী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণটি দশ মাসের বেশী সময় ধরে ৪২ ইঞ্চি সাইজের কালো রঙের একটি ট্রাঙ্কে বন্ধি ছিল।

মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না থাকলেও চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালকের উদ্যোগে সেটি ধারণ করে গোপনে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। মুুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সচিবালয়ের ফিল্ম ডিভিশনের আলমারী থেকে সেটি সরানো হয়। ঢাকার দোহারের এক গ্রামের ধানের গোলায়। এরপর সেটি নেয়া হয় কলকাতায়। স্বাধীনতার পর ওই ফিল্ম ভর্তি ট্রাঙ্ক আনা হয় ঢাকায়। এরপর এডিট করে শুরু হয় সম্প্রচার। ৭ই মার্চের ভাষন যে ক’জন মিলে রেকর্ড ও ধরণ করেছিলেন তাদের একজন আমজাদ আলী খন্দকার (৭৮)।

১৯৬৫ সালে কাজ শিখে ’৬৮ সালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফিল্ম ডিভিশনে চাকরি পাওয়া আমজাদ ২০০৪ সালের ২৯ জুন অবসরে যান। চাকরি সুবাদে বঙ্গবন্ধুর অনেক কর্ম রাজনৈতিক কর্মসূচির দৃশ্য ধারণ করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। পাকিস্তান আমলে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচীতে দয়িত্ব পালন করতে অনাগ্রহী ছিলেন। পরিচালকসহ তারা আটজন ছিলেন আগ্রহী। মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের পদ্মা নদীভাঙা এলাকা থেকে আশির দশকে সাভার পৌর এলাকার মধ্যগেন্ডা মহল্লায় বাড়ি করেন তার বাবা। স্ত্রী নেই, অসুস্থ আমজাদ এখন তার বৃদ্ধা মা ও সন্তানদের নিয়ে সেখানেই থাকেন। ৭ই মার্চের ভাষণের ভিডিও চিত্র ধারণসহ বঙ্গবন্ধুর কর্ম তৎপরতার বর্ননা করেছেন তিনি স্মৃতি থেকে।

নিজ বাসায় বসে দীর্ঘ আলাচারিতায় আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালক আবুল খায়ের মহিবুবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সকাল সাতটায় ক্যামেরাসহ আনুসাঙ্গিক যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনিসহ সাতজন রেসকোর্স ময়দানে যান। ফিল্মের ক্যামেরা ওইদিনের মঞ্চের ডায়াসের তিন থেকে সাড়ে ৩ ফিট দূরে স্থাপন করেন। ভরদুপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান নির্ভয়ে ডায়াসের সামনে দাঁড়িয়ে তার কালজয়ী ভাষণ দেন। এরপর বঙ্গবন্ধু মঞ্চ থেকে নেমে বাসায় চলে যান। আমজাদ জানান, ওইদিন গুজব ছিল বোমা মেরে সভামঞ্চ উড়িয়ে দেয়া হতে পারে। এতে তারাও ভয়ে ছিলেন। এরমধ্যে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলে লাখো জনতা উল্লাস করেন। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠে কারো সাথে কোনো কথা বলেননি। পিনপতন নিরবতায় নিজের মতো করে বক্তব্য রেখে নেমে যান। জনতা মুহুর্মুহু শ্লোগান দেয়।

আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, সেসময় যেকোনো কিছু রেকর্ড করা হলে তা এফডিসিতে ডেভলপ করা হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত কোনো কিছুর সেখানে কাজ করার অনুমতি ছিল না। এ অবস্থায় ফিল্ম ডিভিশনের পরিচালকের পরামর্শে কৌশলে ‘সাইক্লোন’ ও নির্বাচন’-এমন সব নাম ব্যবহার করে তারা বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচীর রেকর্ডিং ডেভলপ করতেন। ৭ মার্চের ভাষন ডেভলপ করার পর আমজাদ সেটি পরিচালক আবুল খায়ের মহিবুবুর রহমানের কাছে জমা দেন। পরে তিনি তা অফিসের আলমারীতে রেখে দেন। ওইদিনের বক্তব্য রেকর্ডের ব্যপারে তৎকালীন তথ্য মন্ত্রণালয় কোনো নির্দেশনা দেননি জানিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, আবুল খায়েরের ব্যক্তিগত আগ্রহে তা রেকর্ড করা হয়।

তিনি বলেন, ২৫ মার্চের কালো রাতে বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হয়। ওইরাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে ওই ভাষণের ডকুমেন্টারী নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন আবুল খায়ের। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, এরমধ্যে অফিস খোলা। তারা অফিস করেন। পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে ৯ এপ্রিল আবুল খায়ের তার কক্ষে ডেকে নেন আমজাদকে। তিনি তাকে কিছু টাকা দিয়ে বড় সাইজের একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনতে বলেন। আমজাদ সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি সাইজের কালো রঙের একটি ট্রাঙ্ক কিনে আনেন। ওই ট্যাঙ্কে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ফিল্মসহ আগের রেকর্ডকৃত বঙ্গবন্ধুর সব ডকুমেন্টস এবং বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে করা একটি ডকুমেন্টারী ভরেন খায়ের।

পরদিন আমজাদকে ডেকে খায়ের বলেন, সেই ট্রাঙ্ক দোহারের জয়পাড়ায় তার নিকট আত্নীয় মজিদ দারোগার বাড়িতে নিয়ে যেতে। খায়েরের নির্দেশে আমজাদ যাওয়ার আগে তার বাবার সাথে বিজি প্রেসে (তার বাবা বিজিপ্রেসে চাকরি করতেন) দেখা করার অনুমতি চান। পরদিন বাবা সাফায়েত আলী খন্দকারের সাথে দেখা করে আমজাদ এর পরদিন ট্যাঙ্ক নিয়ে দোহারে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন তিনি। কিন্তু সচিবালয়ের ভেতরকার তৎকালীন টিনশেড অফিস থেকে ট্রাঙ্কটি বের করতে বেগ পেতে হয় আমজাদকে। গেটে পাক বাহিনীর প্রহড়া, ভেতরকার অবস্থাও অনুকুলে ছিল না।

এ অবস্থায় দ্বিতীয় গেট দিয়ে সার্জেন্ট ফরিদের সহায়তায় বেবীট্যাক্সিযোগে তিনি ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হন। রাস্তায় টহলরত পাক বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে প্রেসক্লাব, কার্জন হল পেরিয়ে সুয়ারিঘাটে গিয়ে নামেন। দুইজন কুলি সেই ট্রাঙ্ক নৌকায় তুলে দেয়। নদী পারি দিয়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা যাওয়ার পর একটি বাসের ছাদে করে ট্রাঙ্কটি নিয়ে বাসের শেষ ষ্টেশন নবাবগঞ্জের বখসনগরে নামেন তিনি। এরপর একটি ঘোড়ার পিঠের উপর ট্রাঙ্কটি তুলে তিনি ও ঘোড়ার রাখাল দু’পাশে ধরে ৬ মাইল পথ হেটে বিকালে গিয়ে পৌছান মজিদ দারোগার বাড়ি। খায়েরের কথা বলে মজিদ দারোগাকে সেটি রাখতে বলেন আমজাদ। এদিকে আমজাদ ট্রাঙ্ক নিয়ে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পরতে পারেন এমন দুশ্চিন্তায় গোপনে পিছনে পিছনে গিয়ে সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে হাজির হন খায়ের। তারা দু’জন ওই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন খায়ের ঢাকায় ফিরেন আর আমজাদ সেখান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে তার বাড়ি মানিকগঞ্জের হরিরামপুর চলে যান। বাড়িতে দুদিন থেকে আমজাদ লঞ্চে ঢাকায় ফিরেন। আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ওই ট্রাঙ্কে কি আছে তা তিনি এবং খায়ের ছাড়া কেউ জানতো না।

এদিকে কয়েকদিন পর দোহারে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢুকেছে খবর পেয়ে খায়ের ওই ট্রাঙ্কটি পাঠান মজিদের বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে করকোসাই গ্রামে তার ভাই (মজিদ দারোগার) দানেশ খার বাড়িতে। সেখানে খায়েরের পরিবার ছিল। ওই বাড়িতে ধানের গোলার ভেতর ট্রাঙ্কটি লুকিয়ে রাখা হয়। পরদিন আমজাদ সেখানে গিয়ে খায়েরের স্ত্রী সন্তানদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। এর পরদিন খায়ের পরিবার নিয়ে কলকাতা চলে যান। এরপর মুক্তিবাহিনী ও কিছু লোকের সহায়তায় খায়ের নানাভাবে গোপনে ওই ট্রাঙ্কটি কলকাতা নিয়ে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খায়ের পরিবার নিয়ে দেশে ফেরার সময় ট্রাঙ্কটি নিয়ে ফিরেন। পাকিস্তান ডিএফপি বাংলাদেশ ডিএফপি হলে ফিল্ম বিভাগের স্টাফরা নতুনভাবে চাকরিতে যোগ দেন।

মুক্তিযুদ্ধে আগে ও যুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে ঢাকার তেজতুরি পাড়ায় থাকতেন বিটিভির এক সময়কার চীফ ক্যামেরাম্যান আমজাদ আলী খন্দকার। তিনি বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রচারের জন্য ৭ই মার্চের ভাষণটি এডিট করা হয়েছে। পরে বিটিভি ও সব সিনেমা হলে প্রচার করা হয়েছে তাদের ধারণকৃত ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক ভাষণটি। এরআগে লোকজন রেডিওতে ভাষণটি শুনেছেন, ভিডিও দেখেননি বলেও দাবি করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সাথে অনেক স্মৃতি রয়েছে জানিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে তৎকালীন চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের ফিল্ম ডিভিশনের ১১ জন স্টাফ গিয়েছিলেন তার প্রতিক্রিয়া জানতে ও সেই দৃশ্য ধারণ করতে।

তাদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ আপনার সাথে ছবি তুলতে চাই’-বঙ্গবন্ধু তাদেরকে বলেন, ‘আমার চেয়ে আর বেশী গরিব কে ? -আয় কাছে ছবি তুলি’। পিআইডির তৎকালীন ফটোগ্রাফার কাইয়ুম বঙ্গবন্ধুর সাথে তাদের ছবি তুলেন। যে ছবি আমজাদের বাড়ির দেয়ালে এখনো স্মৃতি হয়ে আছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন আমজাদ ফার্মগেটে দায়িত্ব পালন শেষে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়ে চিত্র ধারন করেন বলেও জানান।

তিনি বলেন, ডিএফপি থেকে তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রথম ক্যামেরাপারর্সন নিযুক্ত হন। দেশে ফিরে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান হয়ে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরের বাড়িতে ফিরলে স্বজন ছাড়াও হাজার হাজার মানুষের আনন্দ অশ্রু দেখে আমজাদের চোখেও জ্বল আসে। এরপর ওআইসি সম্মেলন থেকে শুরু করে টাঙ্গাঈল সফর, ভারত সফরসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমজাদ ক্যামেরা নিয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর। ভারতে বাংলাদেশ মিশনে চা পানের সময় বঙ্গবন্ধু তাকে পিছন থেকে জড়িয় ধরলে অন্য ক্যামেরাম্যানরা ঈর্ষান্নিত হন বলেও জানান আমজাদ। বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুর পর নদীতে ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের মধ্যে তারা টুঙ্গিপাড়া যান। সদরঘাট থেকে ছাড়া স্টিমার মুন্সীগঞ্জে রাতে নোঙর করে। পরদিন সকালে তারা ফের যাত্রা শুরু করেন। সন্ধ্যায় টুঙ্গিপাড়া পৌছে সেখানে তারা পাঁচদিন ছিলেন। কয়েক মাস পর আমজাদ অসুস্থ হলে তিনি চিকিৎসা নিয়ে অন্য দায়িত্ব পালন করেন।

আমজাদ বলেন, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিয়ে দায়িত্ব নিলে প্রথমদিন তার কার্যালয়ে গেলে সেই দৃশ্যও তিনি ধারণ করেন। গত দুইবছর আগে সংসদ ভবনে প্রধনমন্ত্রীর সাথে স্বল্প সময়ের জন্য তার দেখা হয়েছে জানিয়ে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, গত বছরের ৭ই মার্চ এক অনুষ্ঠানে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ তাকে সম্মাননা জানিয়েছেন। এছাড়া ওইভাবে কেউ তার খোঁজ রাখেন না। এনিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই এই চার পুত্র সন্তানের জনকের।

মার্চ ৭, ২০২১ at১২:৩৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসএইস/এমএসএইস