দেশে মাদকের বিস্তার সর্বগ্রাসী রূপ!

দেশে মাদকের বিস্তার সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। হাত বাড়ালেই মিলছে ইয়াবা, গাঁজা, মদ, ফেনসিডিল, হেরোইনসহ নানাবিধ মাদক। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র পৌঁছে গেছে এর ভয়াল ছোবল। আসলের ভিড়ে অনেক নকল মাদকও বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিন মাদকের চালান ধরা পড়লেও মাদকসেবীরা হাত বাড়ালেই পাচ্ছে তাদের চাহিদামতো ৩৫ রঙের ইয়াবা, গাঁজা, মদ, হেরোইনসহ যেকোনো ধরনের মাদক। কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে কড়াকড়ির পর বদলেছে পাচারের রুট।

মিয়ানমার-ভারত হয়ে সীমান্তপথে ঢুকছে ইয়াবার চালান। সীমান্ত আসছে গাঁজার চালানও। দাম বেশি হলেও হঠাৎ করে কদর বেড়েছে ফেনসিডিলের। নতুন ধরনের কিছু মাদক ভাবনায় ফেলেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে। বৈশি^ক মহামারি করোনার কারণে বিদেশি মদ আমদানি বন্ধ থাকলেও বাজারে মদের অভাব নেই। এরমধ্যে ভেজাল বিদেশি মদে বাজার সয়লাব। ইয়াবার সহজ লভ্যতায় কদর খানিকটা কমেছে হোরোইনের। তাই কমেছে চালানও। তবে অন্য মাদকের চাহিদা বাড়ায় বেপরোয় কারবারিরা। নতুন করেও অনেকে যুক্ত হচ্ছে এই পেশায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তালিকায় উঠে এসেছে ৮ হাজার ৩২৪ জনের নাম, যাদের অধিকাংশই পলাতক থেকে সক্রিয়।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, মাদকের চালান ও মাদক ব্যবসায়ীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবসময় তৎপর রয়েছে। চলছে গোয়েন্দা কার্যক্রমও। মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করছে সরকার। এরসঙ্গে যারাই জড়িত হোক না কেন পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আহসানুল জব্বার বলেছেন, কড়াকড়ি করা হলে রুট বদল করে অন্যপথে মাদক প্রবেশ করে। তখন নতুন রুটে কড়াকড়ি করা হয়। চাহিদা থাকায় ইয়াবা বেশি আসছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সব সংস্থা সমন্বিতভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জানুয়ারির সর্বশেষ তালিকায় ঢাকা বিভাগে ৩ হাজার ২৪, রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ১৮৩ জন, রংপুর বিভাগে ৮১৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ৮১২ জন, খুলনা বিভাগে ৮৬১ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৯৪ জন, সিলেট বিভাগে ৯২ জন এবং বরিশাল বিভাগে ২৫১ জনের নাম রয়েছে। এরমধ্যে শুধু কক্সবাজার জেলায় রয়েছে ১৯৬ জনের নাম। তালিকায় থাকা শীর্ষ মাদক কারবারিদের মধ্যে কক্সবাজারের উত্তর বুনিয়াছড়ার নজরুল ইসলামের পুত্র জহিরুল ইসলাম ওরফে এলাচ ফারুক আটক হয়ে কারাগারে রয়েছে। পলাতকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কক্সবাজার লাইট হাউসপাড়ার তোফায়েল আহমেদের পুত্র কাজী মোরশেদ আহমেদ বাবু, চকরিয়ার হাচু মিয়ার পুত্র আজিজুল হক সোহেল, টেকনাফ কোনাপাড়া উলুচামারীর মৃত সিদ্দিক আহমেদের পুত্র তাহের আহমেদ, উখিয়ার মরিচা মধু ঘোরনার সালামের পুত্র সেলিম এবং উখিয়ার তোফায়েল আহমেদের পুত্র নজির আহমেদ। এদের মধ্যে নজির পাইকারি গাঁজা ব্যবসায়ী। অন্যরা ইয়াবা কারবারি।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এলাকাভিত্তিক মাদক ব্যবসায়ীদের পৃথক তালিকা রয়েছে। থানা পুলিশ ছাড়াও জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পৃথক তালিকা রয়েছে। হালনাগাদ হওয়া তালিকায় প্রতিনিয়ত নতুন নাম যোগ হচ্ছে। মাদকের বাহকরা ধরা পরে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেলেও চোরাচালানি এবং হোতারা থেকে যাচ্ছে অধরা। সাক্ষীর অভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে জড়িতরা, বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে বিচারকাজ। এ অবস্থায় পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত অভিযানে ৭ লাখ ৭৭ হাজার ৫৯ মাদক মামলায় আসামি ছিল ৯ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭১ জন। উদ্ধার হয় ২১ কোটি ৪৬ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৭ পিস ইয়াবা, ২ হাজার ৪৯১.৯৬ কেজি হেরোইন, ৪৩.৬৯৬ কেজি কোকেন, ২১৭.৩৯৭ কেজি আফিম, ৫ লাখ ৩ হাজার ৯১৭.৩৩৬ কেজি গাজা, ১ কোটি ৭ লাখ ১৩ হাজার ৮১০ বোতল ফেনসিডিল, ২২ হাজার ৪১৬.৫১৩ লিটার তরল ফেনসিডিল, ২০ লাখ ৮৩ হাজার ১৩০ বোতল বিদেশি মদ, ৮ হাজার ৯৫৪.৩১৮ লিটার বিদেশি মদ, ১১ লাখ ৫২ হাজার ৯১৯ ক্যান বিয়ার, ৪৬ হাজার ২১৫ বোতল বিয়ার ও ১৪ লাখ ৬ হাজার ৯১১ অ্যাম্পুল (ইনজেকটিং ড্রাগ) উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও কোস্ট গার্ড এসব অভিযান চালায়। ঢাকা মহানগর পুলিশ বলছে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১১ হাজার ১১৬ মামলায় ১৬ হাজার ৫২৯ জনকে বিভিন্ন ধরনের মাদকসহ আটক করা হয়েছে।

জানা গেছে, ইয়াবার ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে ২০১৮ সালের ৪ মে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু হয়ে কয়েক মাস পরই তা থমকে গেছে। র‌্যাব-পুলিশের ওই অভিযানে চার নারীসহ ৩ শতাধিক মাদক কারবারি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়। এরমধ্যে মধ্যে ইয়াবার রুট হিসেবে পরিচিত শুধু টেকনাফেই নিহত হয় ৭৮ জন। নিহতের তালিকায় ২ নারীসহ ৬৫ জন রোহিঙ্গাও রয়েছেন। অভিযানের মধ্যে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ১০২ জন ইয়াবা ব্যবসায়ী কক্সবাজার জেলার টেকনাফ পাইলট স্কুলের মাঠে পুলিশের এক সমাবেশে ৩ লাখ ইয়াবা বড়ি ও ৩০টি আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। সাজা শেষে তাদের অনেকে এখন মুক্ত। তবে যেদিন ওই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি সাড়ম্বরে ঘটানো হয় সেই দিনই কক্সবাজার জেলার তিনটি স্থান থেকে ৫ লাখ ৬০ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়। তার পরদিনও উদ্ধার করা হয় ২০ হাজার ইয়াবা। এখনো ওই অঞ্চলে ইয়াবার চালান হাতবদলের খবর রয়েছে। কক্সবাজার গোয়েন্দা পুলিশের তালিকায় ওই জেলায় ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত এক হাজার ১৫১ ব্যক্তির নাম আছে। তাদের মধ্যে শুধু টেকনাফেরই ৯১২ জন। ওই হিসাবে টেকনাফের মোট ইয়াবা কারবারির মাত্র ৯ ভাগের ১ ভাগ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও বাকিরা অধরা। অভিযানকালে ফেনীর ছাগলনাইয়ায় ২১ জন, জামালপুরে একজন, রাজবাড়িতে ৬ নারী, নওগাঁয় ৫৬ জনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক মাদক কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। বিশেষ অভিযানের কারণে মাদক কারবারিদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি হলেও এতে ভাটা পরায় তারা ফের সক্রিয় হয়েছে।

এদিকে ইয়াবার পাশাপাশি দেশের সর্বত্র গাজার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। দেশের বিভিন্নস্থানে ফুলের টবে গাছ বুনে গাঁজার চাষ হচ্ছে। আবার সীমান্ত পাড়ি দিয়েও আসছে মণকে মণ গাঁজার চালান। আসছে ফেনসিডিল ও হোরোইনের চালানও। পাশাপাশি খবর মিলছে ‘আইস’ ও ‘খাত’সহ নতুন ধরনের মাদক হাতবদলের। মাদকের দৌরাত্ম্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাগাতার অভিযানের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের কৌশল বদলের কারণে তারা যেন অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ছে, বিশেষ অভিযানেও ঠেকানো যাচ্ছে না এর আগ্রাসন। মদ আমদানি বন্ধ থাকায় ওয়্যার হাউস ও বারে এর স্বল্পতা থাকলেও গোপনে বেশি দামে মিলছে বিদেশি মদ ও বিয়ার। বাজারে থাকা বিষাক্ত মদপানে গত দুমাসে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ref: bhorerkagoj