আসন্ন ইউপি নির্বাচন: আ.লীগের তৃণমূলে অস্থিরতা, বাড়ছে দলীয় বিভাজন

দেশজুড়ে ইনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ডামাডোল। স্থানীয় সরকারের এই তৃণমূল পরিষদে চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়নের বিধান থাকায় সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন। দলগুলোর তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের গভীর আগ্রহ এই নির্বাচন নিয়ে। বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলে বিজয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। সে কারণে শুরু হয়েছে নৌকা নিয়ে কাড়াকাড়ি। এই প্রতিযোগিতায় অস্থির হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের তৃণমূল।

কেন্দ্র থেকে বারবার কঠোর বার্তা দেয়া হলেও কোনোভাবেই কমছে না এই অস্থিরতা। দলের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী নেতারা নিজ দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ছুঁড়ছেন বাক্যবান। রটাচ্ছেন কুৎসা। অভিযোগ করছেন উপরমহলে। বাড়ছে দলীয় বিভাজন। কেউ স্থানীয় সংসদ সদস্য, কেউ আবার প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা, কেউ জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অথবা সাধারণ সম্পাদকের অনুকম্পা পেতে মরিয়া। নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে তা রাজনীতি থেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিরোধে গড়ায়। একে অপরের চরিত্র হননের খেলায় মেতে উঠেন নেতারা। এ অস্থিরতা সামাল দিতে কেন্দ্রীয় নেতারা হিমশিম।

প্রথম দফায় ২০ জেলার ৬৩ উপজেলার ৩২৩ টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১১ এপ্রিল। চলতি বছরই

পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপি চার হাজারের বেশি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করতে দলীয় স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে বাড়ছে অস্বস্তি। সবচেয়ে বড় ক্ষতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতিতে। একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকায় একক প্রার্থী চূড়ান্ত করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

আসন্ন ইউপি নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চান এমন বেশ কয়েকজন প্রার্থী, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও কয়েকজন সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মাঠ পর্যায়ের অস্থির পরিস্থিতির কথা। তাদের মতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় তৃণমূলে দল অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যারা দলীয় মনোনয়ন পেতে চান তারা নিজেরা নানা বিভক্তিতে জড়িয়ে পড়ছেন। কারণ সবাই প্রার্থী হতে চান। পেতে চান দলীয় প্রতীক নৌকা।

কয়েকজন সরকার দলীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের একজন জানান, উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণ করতে আমাদের খুব একটা চাপের মধ্যে পড়তে হয় না। অনেকটা স্বস্তি নিয়েই তৃণমূলের সবার মতামত নিয়ে ৩ জনের একটি প্রার্থী প্যানেল ঠিক করে কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেই। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড একজন প্রার্থী চূড়ান্ত করে। আমাদের নেতাকর্মীরা দল মনোনীত প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন। কিন্তু সমস্যা হলো ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ঘিরে। এই নির্বাচন এলেই আমাদের প্রেসার বেড়ে যায়। আমরা নানামূখী চাপে থাকি। বিশেষ করে আমার নির্বাচনী এলাকায় ২০ টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে। প্রতিটিতে গড়ে ৫ জন করে প্রার্থী। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকও প্রার্থী হয়ে যান। দলের সহযোগী সংগঠনসহ এমনকি ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনের নেতারাও চেয়ারম্যান পদে দলের মনোনয়ন পেতে উদগ্রীব। তখন নিজেদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। প্রার্থীরা নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। নিজেদের গ্রুপ ভারী করতে মরিয়া হয়ে উঠেন। কেউ কাউকে মানেন না। এক প্রার্থী আরেক প্রার্থীর চরিত্র হননে নানা কুৎসা রটানোর কাজে নেমে যান। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে সর্বত্র গীবত-সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। কেউ কারো কোনো কথা শুনেন না। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে যায়। আমরা সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদেরকেও তখন বিভক্তির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। না চাইলেও আমাদের বিপক্ষেও নানা গ্রুপ দাঁড়িয়ে যায়। অনেকেই প্রার্থী হতে আমাদের সমর্থন চান। তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না। কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন জনের প্যানেল আমরা চূড়ান্তও করতে পারি না। তখন উপায় না দেখে সব প্রার্থীর নামই কেন্দ্রে পাঠাতে বাধ্য হই।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভোরের কাগজকে জানান, ইউপি প্রার্থীর প্যানেল চূড়ান্ত করে কেন্দ্রে পাঠাতে আমাদের অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। কারো নাম বাদ গেলে ওই প্রার্থী তখন প্রচার করে বেড়ায় যে বড় ধরণের আর্থিক লেনদেনে প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। অমুক প্রার্থী হাইব্রিড, রাজাকারের পরিবার। কেউ বিএনপি পরিবার থেকে এসেছে এমন নানা সমালোচনা পেছন থেকে শুনতে হয়। আমাদের চেইন অব কমান্ড ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ওই নেতার মতে, উপজেলা ও পৌরসভা পর্যন্ত দলীয় প্রতীক ঠিক আছে। কিন্তু এর নিচে ইউনিয়ন পর্যায়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন না করে পূর্বের অবস্থায় রাখা হলে আমরা অনেকটা স্বস্তিতে থাকতে পারি। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ-কলহ আর থাকবে না। কেউ কারো বিরুদ্ধে বিষোদগার করবে না। চেইন অব কমান্ড ঠিক থাকবে। এরকম অস্বস্তির কথা শোনা গেছে তৃণমূলের অনেক নেতার মুখেও। তাদের প্রায় সবাই ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার পক্ষে মত দেন।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর একজন সদস্য জানান, দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান তৃণমূলের সব নির্বাচন দলীয় প্রতীকেই হোক। এতে হয় তো কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে পর্যায়ক্রমে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন।

ref: bhorerkagoj