পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলার কার্যক্রম নিম্ন আদালতে এখনো আটকে আছে

আজ থেকে ঠিক একযুগ আগে ২০০৯ সালের এই দিনে সংঘটিত হয় ইতিহাসের বর্বরচিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড। বিডিআর বিদ্রোহের ওই ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলার রায় হলেও একই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়েরকৃত মামলার কার্যক্রম নিম্ন আদালতে এখনো আটকে আছে। মামলাটি বর্তমানে মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। এক বছরের মধ্যে মামলাটি শেষ করা যাবে বলে রাষ্ট্রপক্ষ আশা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু ১২ বছরেও এ মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। কবে বিচার কার্যক্রম শেষ হবে তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতেও পারছেন না।

মামলার পাবলিক প্রসিকিউশন মোশারফ হোসেন কাজল বলেন, বিস্ফোরক আইনে করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ১৮৫ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ও জেরা হয়েছে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় সাড়ে ১২০০ সাক্ষী রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩০০ জন সাক্ষীর (গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর) সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে মামলাটি রায় হবে বলে আশা করছি। বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে বিলম্ব হচ্ছে। করোনার কারণে আসামি এবং সাক্ষীদের আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া প্রতি মাসে দুদিন করে এই মামলার কার্যক্রম চলছে। তার দাবি, প্রচলিত নিয়মেই নিয়ম মতো মামলার কার্যক্রম চলছে।

২০০৯ সালের ঠিক ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা নারকীয় তাণ্ডব চালায় পিলখানায়। তাদের হাতে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট হয়নি। প্রতি বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস পালিত হয়।

বিডিআর বিদ্রোহের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি ও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটির প্রতিবেদনে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বিচার সেনা আইনে করার সুপারিশ করা হলেও উচ্চ আদালতের মতামতের পর সরকার প্রচলিত আইনে এর বিচার করে। নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারকে আর্থিক সুবিধাও দেয়া হয়।বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় দুটি ফৌজদারি মামলা করা হয়। প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এ মামলায় ১৫২ জনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুর আদেশ দেন বিচারিক আদালত। তাদের একজন ছাড়া সবাই তৎকালীন বিডিআরের সদস্য। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয় ১৬১ জনকে। সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পান আরো ২৫৬ জন। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পায় ২৭৮ জন আসামি। সাজা হয় মোট ৫৬৮ জনের। এরপর ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দেয়া রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

গত বছরের গত ৮ জানুয়ারি হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়েছে। রায়ে ডিএডি তৌহিদসহ ১৩৯ জনকে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এ ছাড়া যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে ১৮৫ জনকে। ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে এবং খালাস পেয়েছেন ৪৫ জন।

নিয়ম অনুযায়ী হত্যা মামলায় হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে পারবেন আসামি ও রাষ্ট্র-উভয়পক্ষই। এরপর আপিলের বিচারের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া চ‚ড়ান্তভাবে সম্পন্ন করা হবে। যদিও আপিল বিভাগের রায়ের পর ওই রায়ের রিভিউ আবেদন করার সুযোগ থাকবে। রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি হওয়ার পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে আবেদন করা ছাড়া আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

আপিল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, হত্যা মামলায় হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ৯ আসামি খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। আর হাইকোর্টে খালাস পাওয়া ৭৫ জন এবং সাজা কমে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ৮ আসামি মিলিয়ে ৮৩ জনের ক্ষেত্রে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, বিডিআর বিদ্রোহের হত্যা মামলাটি আপিল পর্যায়ে রয়েছে। যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে তারা অনেকেই আপিল করছে। সরকারও কিছু আপিল করছে।

এদিকে, ফৌজদারি আদালতে দায়ের করা বিস্ফোরক মামলায় ৮৩৪ জন আসামি রয়েছে। এ মামলায় মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। পরে আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বিচার চলাকালে তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়। মামলায় আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক এমপি নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীরও দণ্ড হয়। সাজা ভোগকালীন পিন্টু অসুস্থ হয়ে মারা যান।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালটা শুরু হয়েছিল আর দশটা দিনের মতোই। কিন্তু শেষ হয় রক্ত, লাশ আর বারুদের গন্ধে। মামলার নথি থেকে জানা যায়, বিডিআরের বার্ষিক দরবারের ওই অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায় সদর দপ্তরের দরবার হলে। উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম এ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা। ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন। দরবার শুরুর পর ডিজির বক্তব্য চলাকালে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন। ডিজির পর হত্যা করা হয় আরো কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এভাবে দুই দিন ধরে চলতে থাকে ধ্বংসযজ্ঞ। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ‘বিডিআর’ এর নাম পরিবর্তন করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয়।

পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ ব্যক্তিদের স্মরণে আজ বৃহস্পতিবার শাহাদৎবার্ষিকী পালন করা হবে বলে বিজিবি সূত্র জানিয়েছে। বিজিবি সদর দপ্তরসহ সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় খতমে কুরআন, বিজিবির সব মসজিদ এবং বিওপি পর্যায়ে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানরা, সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২১ at১০:০৬:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/ভিকে/এমএসএইস