ফুল দেয়ার এক ঘণ্টা আগে অরক্ষিত শহীদ মিনার

করোনার কারণে এ বছর সারাদেশে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় তা ছিল প্রায় উপেক্ষিত। অরক্ষিত শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার ঘণ্টাখানিক আগেও সেখানে কুকুরের অবস্থান দেখা গেছে। দেখা যায়নি শহীদ মিনারের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। আর ফুল দেয়ার সময় চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হলেও পুলিশ ছিল নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এমনকি বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাা না করে দৌলতপুর থানার ওসিকে শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে একের পর এক ফটোসেশনে অংশ নিতে দেখা যায়।

শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাত পৌনে ১১টার দিকে স্থানীয় এক সংবাদকর্মী দৌলতপুর উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ভাই শহীদ মিনারে আসলাম। কোনো মানুষ নাই, শহীদ মিনারের বেদিতে কুকুর শুয়ে আছে।’ নিরাপত্তার জন্য পুলিশের আগাম উপস্থিত থাকার কথা পুলিশও কি নেই- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে কুকুর ছাড়া কোনো মানুষই নাই। এদিকে অরক্ষিত শহীদ মিনারে ফুল দেয়ার আগ মুহূর্তে কুকুরের অবস্থানের বিষয়টি নিয়ে অনেকে ব্যঙ্গক্তি করে এটিকে ‘শহীদ মিনারের বাড়তি নিরাপত্তার ডগ স্কোয়াড’ বলে মন্তব্য করেন।

পরে রাত সাড়ে ১১টার দিকে শহীদ মিনারে সরেজমিনে গিয়ে বহু মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে। উপস্থিত সংবাদকর্মীদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দৌলতপুর থানার ওসি জহুরুল আলম রাত পৌনে ১২টার দিকে শহীদ মিনারে আসেন। সংসদ সদস্যের প্রটোকলের পুলিশ ছাড়া বাড়তি পুলিশ ওসি আসার আগে দেখা যায়নি বলে উপস্থিত লোকজন জানান। অথচ শহীদ মিনারের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য এবং বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সবার আগে পুলিশ এসে অবস্থান করার কথা। ফুল দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসার কিছুক্ষণ আগে সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ মামুন ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তারসহ আওয়ামী লীগের দলীয় নেতারা ও সরকারি কর্মকর্তারা পেছনের দোতলা থেকে শহীদ মিনারে আসেন। এর আগে থেকেই এমপির পক্ষে মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল, করোনার কারণে সবাইকে সরকারি বিধি-নিষেধ মেনে ফুল দেয়ার কথা।

ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় শহীদ মিনারের ওপর ছবি তোলার বিশৃঙ্খলা

রাত ১২টা ১ মিনিটে রীতি অনুযায়ী সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ দলীয় নেতাদের নিয়ে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদ মামুন উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তাদের নিয়ে শ্রদ্ধা জানান। উপজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দৌলতপুর থানা, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ পর্যায়ক্রমে ফুল দেয়।

সংসদ সদস্য ফুল দেয়ার সময় থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত অসংখ্য মানুষকে অহেতুক শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে দেখা যায়। তাদের ভিড়ের কারণে সাংবাদিকদের ছবি তুলতে বেগ পেতে হয়। ফুল দেয়া আর ছবি নেয়ার ঘটনায় শহীদ মিনারে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবুও বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে পুলিশের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এ সময় পুলিশ সদস্যদের ভূমিকা ছিল পুরোপুরি নীরব দর্শকের মতো। একপর্যায়ে আবারো সংসদ সদস্যের পক্ষে শহীদ মিনারের ওপর থেকে মানুষের ভিড় কমানোর নির্দেশের কথা মাইকে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। খোদ সংসদ সদস্যের কথাও পাত্তা পায়নি ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকাদের কাছে। অন্যদিকে দৌলতপুর থানার ওসি জহুরুল আলম ভিড় সরানোর জন্য পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেয়া তো দূরের কথা ওসি নিজেও ফটোসেশনে অংশ নেন। একের পর এক বিভিন্ন জনের সঙ্গে ওসিকে শহীদ মিনারের ওপর ছবি তুলতে দেখা গেছে।

শহীদ মিনারে ভিড় সামাল না দিয়ে সেলফি তোলায় ব্যস্ত ওসি জহুরুল আলম

ফুল দেয়ার পর্ব শেষ হলে সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ্ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। এরপর যথারীতি এক মিনিট নীরবতা পালন শেষে ভাষা শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু মোনাজাতের সময়েও এক তরুণীসহ আরো কয়েক যুবককে শহীদ মিনারের ওপরেই দাঁড়িয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। তারা হয়তো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এ কারণে মোনাজাতে অংশ নেননি বলে ধারণা করা হলেও পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই তরুণী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বাড়ি এ উপজেলার ফিলিপনগর এলাকায়। তবে তিনি অন্য ধর্মের নন। তার সঙ্গে একই কাজে ব্যস্ত থাকা অন্যদের পরিচয় জানা যায়নি।

পরে উপস্থিত অনেকে মন্তব্য করেন, কোনো কারণে মোনাজাতে যদি কারো আপত্তি কিংবা বাধা থাকেও তবু অন্তত সবার প্রতি সম্মান দেখিয়ে শহীদ মিনার থেকে নিচে নেমে ওই সময়টুকু নীরব থাকা যেত। শহীদ মিনারকে তো কেউ তুলে নিয়ে যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে মোনাজাতের পরেও তারা ছবি তুলতে পারতেন। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, উপজেলা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণেই একুশের প্রথম প্রহরে এ ধরনের ভজঘট অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন আগে থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়ানো যেত বলে উপস্থিত অনেকে মনে করছেন।

ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২১ at১৩:২৫:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরএস/এমআরএইস