করোনা মহামারিত বড় ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধে যখন বাড়তি সময় চাচ্ছেন, ঠিক তখন অনন্য দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছেন দেশের কৃষকরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১৬ হাজার ৫৬ কোটি ১৬ লাখ টাকার ঋণ শোধ করেছেন কৃষকরা। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আদায় বেড়েছে দুই হাজার ৫২৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর আগে ২০১৯–২০ অর্থবছরে (জুলাই-জানুয়ারি) সময়ে আদায় হয়েছিল ১৩ হাজার ৫২৮ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) কয়েকটি ব্যাংক বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ অর্জন করলেও বেশিরভাগ ব্যাংক লক্ষ্যের ৫০ শতাংশের নিচে কৃষিঋণ বিতরণ করেছে। এরমধ্যে ২০ শতাংশেরও নিচে রয়েছে ১১ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর ব্যাংক খাতে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণ হয়েছে ১৪ হাজার ১৪৮ কোটি ৭২ লাখ টাকা। বিতরণের পরিমাণ বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৫৩ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত অর্থবছর ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৭ মাসে বিতরণ হয়েছিল ১৩ হাজার ১০৪ কোটি টাকা, যা ছিল ৫৪ দশমিক ৩২ শতাংশ।
কৃষিতে উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ৫ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ খাতে ঋণ বিতরণে নানা সুযোগ সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া কৃষিখাতের ঋণের অন্তত ৬০ শতাংশ শস্য খাতে দিতে হবে। তারপরও এ খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ দিচ্ছে ব্যাংক।
লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চরমভাবে ব্যর্থ সীমান্ত ব্যাংক। তাদের কৃষি ঋণ বিতরণের হার এক শতাংশের নিচে। অন্যদিকে গত সাত মাসে এক টাকাও বিতরণ করেনি দুই ব্যাংক। ব্যাংকগুলো হলো- উরি ব্যাংক এবং কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ।
সাত মাসে যেসব ব্যাংকের ঋণ বিতরণের হার ২০ শতাংশেরও নিচে সেগুলো হলো- বিদেশি খাতের উরি ব্যাংক, বেসরকারি খাতের এবি, কমিউনিটি, গ্লোবাল ইসলামী, আইএফআইসি, সীমান্ত, স্ট্যান্ডার্ড, দ্য সিটি, ইউনিয়ন ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরে সরকারি মালিকানার বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা। জুলাই-জানুয়ারি সময়ে বিতরণ করা হয়েছে ছয় হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এ ঋণ পুরো বছরের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৫৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য নির্ধারিত ১৫ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিতরণ হয়েছে সাত হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা বা ৫০ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে কৃষিঋণের স্থিতি বা পরিমাণ ৪৪ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। যার মধ্যে জানুয়ারি পর্যন্ত কৃষি খাতে খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ। মূলধারার কৃষিঋণের পাশাপাশি বর্তমানে কৃষিখাতে চার শতাংশ সুদে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায়ও কৃষিঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
এদিকে, করোনার সময়েও কৃষি খাতের উৎপাদন সচল ছিল। তাই এ খাতে ঋণের প্রয়োজনও বেশি ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো তাদের সঠিক সময় ঋণ সহায়তা দেয়নি। ফলে প্রথমবারের মতো গেল অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় ব্যাংকগুলো। গত অর্থবছরে কৃষকদের জন্য ২৪ হাজার ১২৪ কোটি টাকা ঋণ বরাদ্দ রেখেছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু অর্থবছরের শেষে এ খাতের ঋণ বিতরণের অংক দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে গেল অর্থবছরে লক্ষ্যের চেয়ে ৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ বা ১ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ কম হয়। এরপরই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষি খাতে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়।
চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লীঋণ বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করেছে ২৬ হাজার ২৯২ কোটি টাকা। যা ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেশি। করোনা মহামারির আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এবং সরকারের কৃষি ও কৃষকবান্ধব নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে টেকসই উন্নয়নের নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রথম ও প্রধান তিনটি লক্ষ্য তথা দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের উদ্দেশ্যে পল্লি অঞ্চলে ব্যাপক হারে কৃষি ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।