তোমাদের দিন শেষ!

আজকে যে কথাগুলো লিখবো সেগুলো বলতে গেলে আরোও ৩/৪ বছর আগেই লেখার চিন্তা ছিল। সময়, পরিস্থিতি, আর কিছু কঠিন বাস্তবতায় সেই চিন্তাগুলো লেখায় রূপ নিতে পারেনি। আগেই বলে রাখি আজকের এই লেখাট পড়ে আমার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা জ্ঞানী গুণী অনেক বন্ধুবান্ধব কিংবা আরও অনেকেই ক্ষেপতে পারে। কিন্তু প্রায় দীর্ঘ ১০ বছরের শিক্ষকতা আর গত ৩/৪ বছরের চাকরির পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো না বলে পারছি না। চলুন মূল আলোচনায় যাওয়া যাক‌।

প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলে মেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করছে। এদের মধ্যে একটা সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে স্মাতক ডিগ্রি অর্জন করে। আর সংখ্যালঘু একটা অতি সৌভাগ্যবান অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুবর্ণ সুযোগ পায়। আর কিছু থাকে যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়। এর মধ্যে আরও একটি অংশ থাকে যারা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকে কমার্স/সাইন্স এ পড়ে স্নাতকে মানবিক বিভাগের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে। অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যেই বিভাগেই পড়ুক না কেন স্নাতকে চাইলেই মানবিক বিভাগের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা যায়। কেউ কেউ বরং ইচ্ছে করেই স্নাতকে এই ট্র্যাক পরিবর্তন করে থাকে। এজন্যই মাঝে মাঝে “পিউর আর্টস” নামে একটা ট্রাম প্রায়শই শোনা যায়। যাদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সবই মানবিক বিভাগের তারাই মূলত পিউর আর্টস নামে পরিচিত। এই পিউর আর্টসের ভাই-বোনদের বলছি, “তোমাদের দিন শেষ!”

মানুষ কেন পড়াশোনা করে? শুধুই জ্ঞান অর্জনের জন্য? আমি মনে করি বিশ্বায়নের এই যুগে শুধুই জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়াশোনা করার থিউরিটা অচল। বর্তমানে পড়াশোনার সাথে এক একটা ছেলে মেয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানটা ওতোপ্রতভাবে জড়িত। অথচ বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই বিশ্বে বাংলাদেশের “পিউর আর্টসরা” ক্যারিয়ার ডেভেলপে অনেকাংশেই পিছিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পিউর আর্টসের গুটি কয়েক অতি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া অনেকেই বৈশ্বিক জ্ঞান বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিগত জ্ঞান তো দূরে থাক ৫-৬ বছর ব্যাপী নিজেদের পঠিত বিষয়ের জ্ঞান-ই তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রী ও পরিচিত ছোট বড় অনেককেই এ বিষয়ে যাচাই করে দেখেছি। সমাজ কর্ম, সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বাংলা ইত্যাদি তো বটেই, পাঁচ ছয় বছর ধরে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স করেও সঠিকভাবে দু লাইন ইংরেজিতে লিখতে বা বলতে পারেনা অনেকেই! এর জন্য আমি দায়ী করবো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই। এসব বিষয়ে কী পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোত? সরকারি কলেজ ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজগুলোতে ছাত্র ছাত্রীরা এসব বিষয়ে ক্লাস করা তো দুরে থাক, পরীক্ষাতেও অংশগ্রহণ করে না। আবার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সেমিস্টারে একটাও ক্লাস না করে অনেকেই অনার্স-ই শেষ করে ফেলে। একই সাথে দীর্ঘ চার বছর অধিকাংশই অলস সময় পার করে, অথবা টিউশনির পিছনেই পুরো সময়টা পার করে দেয়। মৌলিক দক্ষতাগুলোর উন্নয়নেও অধিকাংশেরই আগ্রহ থাকে না।

ফলশ্রুতিতে যা হওয়ার তাই হয়, “বিসিএস নন ক্যাডার থেকেও এদেরকে ভালো কোন পদে সুপারিশ করার সুযোগ থাকে না!” প্রমাণ স্বরূপ সর্বশেষ ৩৮ তম বিসিএস এর নন ক্যাডার প্রথম শ্রেণীর ফলাফল দেখুন, অধিকাংশ পদ-ই টেকনিক্যাল! শুধু ৩৮ ই নয়, বিগত ৩৪ পরবর্তী বিসিএস থেকে খোঁজ নিয়ে দেখুন “পিউর আর্টসের” প্রার্থীদের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আজকের পিএসসির এই রেজাল্টটাই দেখুন। আমার ধারণা এই ধারা সামনেও অব্যাহত থাকবে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন যত বেশি হবে টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর প্রার্থীদের ক্যারিয়ারের সুযোগ ততো বেশি হবে, আর পিউর আর্টসের অভাগা পোলাপান গুলা ততো বেশি বাঁশ খাবে। এটা বলছি না যে তারা সম্পূর্ণ বেকার থাকবে! চাকরির যেমন এখনও অভাব নেই, সামনেও থাকবে না। তবে জব আর ক্যারিয়ারে মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেটা হয়তো সবার-ই জানা থাকা উচিত।

অনার্স মাস্টার্স শেষ করে একটা ছেলে ৫/১০/১২ হাজার টাকার এটা চাকরি করে কোন মতে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়াকে নিশ্চয় ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড জব বলে না! বছরের পর বছর একই পদে থেকে বিনা প্রমোশনে চাকরি জীবন শেষ করাকেও নিশ্চয়ই ক্যারিয়ার বলে না! এমনিতেই এদেশে ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড জবের সংখ্যা নিতান্তই কম। উদাহরণ হিসেবে বিসিএস ক্যাডার, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কিছু নন ক্যাডার, বাংলাদেশ ব্যাংক সহ রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ও অফিসার (জেনারেল) সহ অন্যান্য গুটি কয়েক সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড জবের অফার করে থাকে।

এসব পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও পিউর আর্টসের প্রার্থীদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। কিছু ছাত্র-ছাত্রী হয়তো অসীম ধৈর্য আর অক্লান্ত পরিশ্রম করে শেষ পর্যন্ত মোটামুটি মানের একটা ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড জবে প্রবেশের সোনার চাবিটা পেয়ে যায়, তবে ততোদিনে তার জীবন থেকে হারিয়ে যায় দুরন্ত যৌবন, হারিয়ে যায় দেশকে কিছু দেয়ার মতো ধৈর্য, শক্তি, অনুপ্রেরণা ইত্যাদি। রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় পপুলেশন ডিভিডেন্ডের সুবর্ণ সুফল থেকে।

প্রশ্ন জাগতে পারে কেন এই আলোচনা? ভাই মোটা দাগে কথা একটাই, “মানবিক বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদেরকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে রাষ্ট্রের তথা সরকারের।” এভাবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অবসোলেট হয়ে দেশে বেকারত্বের হার বৃদ্ধির কারণ হয়ে কোন লাভ নেই। আশার কথা হলো বিষয়টি নিয়ে বর্তমান সরকার হয়তো ভাবছে। তাই ২০২২ সাল থেকে এসএসসি পর্যন্ত কোন বিভাগ আর রাখা হচ্ছে না। অর্থাৎ পিউর আর্টসের দিন শেষ হতে চলেছে। কিন্তু বর্তমানে যারা আছে বা আগামী দু চার বছরে যারা পিউর আর্টস থেকে পড়াশোনা করে বের হবে তাদের গতি কী হবে?

আমার পরামর্শ হলো তাদের গতি তাদেরকেই খুঁজে নিতে হবে। তারা যদি নিজেদের পঠিত বিষয়ে ফাঁকি দেয়, কিংবা নিজেদের পঠিত বিষয়ের বাইরে অন্য কোন মৌলিক দক্ষতা অর্জন না করে তাহলে তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোন গতি অন্তত আমি দেখেছি না। সুতরাং, বর্তমানে যারা এই ক্যাটাগরিতে আছেন তারা নিজেদের নিয়ে আরেকবার ভাবুন। এমনকি যাদের ছেলে মেয়ে ভাই বোন আর্টসের ছাত্র ছাত্রী তারাও নড়েচড়ে বসুন।

খুব বেশি মেধাবী বা শীর্ষস্থানীয় কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা অতি আগ্রহী না হলে আর্টসের বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে টেকনিক্যাল কোন বিষয়ে (যেমন আউটসোর্সিং, ইলেকট্রনিকস, এগ্রিকালচার ইত্যাদি) প্রশিক্ষণ নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার চেষ্টা করাই ভালো।

আরেকটা বিষয় না বললেই নয়। এখনও পর্যন্ত মানবিক বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের চাকরির একটা বড় উৎস হচ্ছে “শিক্ষকতা”! বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি, সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান সহ বেশ কিছু বিষয়ে পিউর আর্টসের প্রার্থীদের জন্য এখনো দেশে শিক্ষকতা থেকে ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস জেনারেল এডুকেশন ও টেকনিক্যাল ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য শিক্ষকতা পেশার সামগ্রীক পরিবেশও আশানুরূপ নয়।

এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিসিএস ও রাজস্ব খাতভুক্ত অন্যান্য শিক্ষকরাও নিজেদের কর্মস্থলে বহির্বিশ্বের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। অন্যান্য প্রশাসনের মতো তাদের প্রমোশন হয়না সঠিক সময়, বেতন কাঠামোর শীর্ষে যাওয়াও তাদের জন্য দুরূহ হয়ে উঠে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ লেভেলে ছাত্ররাজনীতির কুফল তো রয়েছেই।

এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এক কথায় বলা যায়, শিক্ষকতা পেশায় আসে দুই শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রী। এক, আর কোন বেটার অপশন নাই তাই। দুই, শিক্ষকতা পেশার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ। তবে প্রথম শ্রেণীটার সংখ্যাই বেশি। প্রতিটা বিসিএসেই দেখা যায় অধিকাংশ প্রার্থীই শিক্ষা/টেকনিক্যাল ক্যাডার চয়েস লিস্টের শেষেই রাখে। এর অর্থই হচ্ছে “শিক্ষকতা পেশা মেধাবীদের টানছেনা” (সাম্প্রতিক প্রথম আলোর রিপোর্ট)। এসব বিবেচনায় নিয়ে বলতে পারি অতি সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষকতা পেশাকেও এদেশে ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড বলা যাচ্ছে না।

তারপরও ধরলাম, প্রতি বছর হয়তো ৫০০-৬০০ প্রার্থী বিসিএস থেকে শিক্ষা/টেকনিক্যাল ক্যাডার হওয়ার সুযোগ পায়, গুটি কয়েক হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে, আরোও ধরলাম সরাসরি বেসরকারি নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন অনার্স মাস্টার্সে হয়তো আরও দু-চার হাজার প্রার্থী শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পায়। তাহলে বাকি লক্ষ লক্ষ পিউর আর্টসের প্রার্থীদের জন্য ভালো কোন অপশন রইলো কি! এর উপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের শোচনীয় অবস্থা, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দশম গ্রেডে বেতন না পাওয়া সহ অসংখ্য অভিযোগে এসব শিক্ষাখাত পরিপূর্ণ। সুতরাং সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। শিক্ষকতা পেশাকে ঢেলে সাজানোর সময় ইতোমধ্যেই পার হয়ে গেছে। এখন ক্যান্সারে রূপ নেওয়ার আগেই এ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। অন্যথায় মানবিক বিভাগের ছাত্র ছাত্রীদের ভবিষ্যত অত্যন্ত অমানবিক হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা থেকেই .

-Najmul Hasan