অবিবাহিত নারীর নামে মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড

দেশে করোনার শুরুর দিকে লকডাউনের সময় সরকারি খাদ্য সহায়তা নিতে যাওয়া দুস্থদের থাপ্পড় মেরে দেশব্যাপী আলোচনায় উঠে আসা কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের সেই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এবার তিনি অবিবাহিত নারীদের নামেও মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড ইস্যু করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক ভাতার কার্ড ইস্যু করতে নিয়মবহির্ভূতভাবে আদায় করেছেন নিজের নির্ধারিত অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া অনলাইনে তথ্য যাচাইয়ের নামে প্রায় ৪ হাজার মানুষের কাছে ১শ টাকা করে গ্রহণ করেছেন উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের আলোচিত চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস।

দৌলতপুর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের মাঠপাড়া গ্রামের ইউনুস আলীর ছেলে এনামুল হক অভিযোগ করেন, প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড ইস্যু করার জন্য চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস তার কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা আদায় করেছেন। এনামুল হক শারীরিক প্রতিবন্ধী। বোয়ালিয়া বাজারপাড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী আশরাফুল ইসলামের কাছ থেকেও কার্ডের জন্য ৬ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে বলে তার অভিযোগ। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একই অঙ্কের টাকা গ্রহণের অভিযোগ করেছেন মাঠপাড়া গ্রামের এনামুল হকের প্রতিবন্ধী ছেলে শাহিন আলী।

বোয়ালিয়া গ্রামের মৃত আনছার আলী শেখের ছেলে মহরম আলী জানান, বয়স্ক ভাতার কার্ড করার জন্য চেয়ারম্যান মহিউদ্দিনকে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। একই গ্রামের মৃত আত্তাহিম মণ্ডলের ছেলে অাফফান মণ্ডল জানান, বয়স্ক ভাতার কার্ড নেয়ার জন্য তিনি চেয়ারম্যানকে ৯ হাজার টাকা দিয়েছেন। এ রকমভাবে অনেকের কাছ থেকে বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দেয়ার জন্য চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস টাকা আদায় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা নিজেদের গচ্ছিত টাকা থেকে আবার কেউ ধার দেনা করে চেয়ারম্যানের অবৈধ দাবি মিটিয়ে কার্ড করতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ চেয়ারম্যানকে তাৎক্ষণিক টাকা দিতে না পারলে তার প্রথম মাসের ভাতার টাকা কেটে নেয়া হয়।

বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রিন্টু আহম্মেদ সাংবাদিকদের জানান, চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস টাকার বিনিময়ে সেখানকার মধুগাড়ি, শেহালা ও বোয়ালিয়া গ্রামের তিন অবিবাহিত নারীর নামে মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। তবে এখনো বিয়ে না হওয়ায় তাদের নাম প্রকাশ বিরত রাখা হয়। এদিকে অবিবাহিত এই নারীদের নামে মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড ইস্যু করার ঘটনাকে চেয়ারম্যানের ‘অভূতপূর্ব’ খামখেয়ালিপনা হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা।

ইউপি মেম্বার রিন্টু আহম্মেদ অভিযোগ করেন, বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারদের মাসিক সম্মানি ভাতা বিগত ৩৪ মাস ধরে বন্ধ করে রেখেছেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস। মেম্বাররা এত মাস যাবত সম্মানি ভাতা আটকে রাথার কারণ জানতে চাইলে চেয়ারম্যান দলীয় ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তাদের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন বলে রিন্টু মেম্বার জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের ১২ জন মেম্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি উপজেলা প্রশাসন।

এ ছাড়া নতুন করে অনলাইনে তথ্য যাচাই বাছাইয়ের নামে ইউনিয়নটির প্রায় ৪ হাজার মানুষের কাছ থেকে ১শ টাকা করে গ্রহণ করেছেন বলেও বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের এই আলোচিত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন দলের দাপুটে চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস তার ব্যক্তিগত লোকদের মাধ্যমে নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব টাকা আদায় করে আসছেন।

এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস বলেন, আমার নামে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা সঠিক নয়। আমার টাকার অভাব আছে নাকি যে আমি এসব টাকা নেব। বরং মেম্বাররাই এ ধরনের অার্থিক দুর্নীতি করে আসছেন। তারাই নিজেদের আত্মীয় স্বজনদের নামে (অবিবাহিত নারী) মাতৃত্বকালীন ভাতার কার্ড করে দিয়েছেন। এখন সব দোষ আমার ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। চেয়ারম্যান দাবি করেন, সামনে নির্বাচন তাই আমি যাতে দলীয় মনোনয়ন না পাই সেই লক্ষে মেম্বাররা আমার বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে মিথ্যাচার করছেন। মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় মোবাইল ফোনে চেয়ারম্যান বলেন, আপনার (প্রতিবেদক) সাথে সরাসরি দেখা করে কথা বলে আসবো সমস্যা নাই।

প্রসঙ্গত, দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে অঘোষিত লকডাউন চলাকালে কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষজনসহ দুস্থ ও অসহায়দের গত ১০ এপ্রিল নিজ কার্যালয়ে ডেকে সরকারি খাদ্য সহায়তা দেয়ার সময় তাদের গায়ে হাত তোলেন চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস। লোক দেখানোর জন্য নিজের পছন্দ মতো ফটোসেশনে অংশ নিতে না পারার অপরাধে তিনি বৃদ্ধ বয়সী ব্যক্তিদের চড় থাপ্পড় মারেন। গালাগাল করেন। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেন। এমনকি নারীদেরকেও পেছন দিক থেকে শাড়ির আঁচল টেনে ধরে লাঞ্ছিত করেন।

চেয়ারম্যান কর্তৃক তাদের নিগৃহীত হওয়ার এই অমানবিক ঘটনার একটি ভিডিও ক্লিপ মুহূর্তেই ভাইরাল হওয়ায় গণমানুষের প্রচণ্ড ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। ক্ষুব্ধ মানুষজন চেয়ারম্যানকে চরম ধিক্কার জানিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেন। একই সঙ্গে চেয়ারম্যান মহিউদ্দিনের উপযুক্ত শাস্তির দাবি ওঠে। দেশজুড়ে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। এ নিয়ে গণমাধ্যমের খবর বের হলে মানুষের সমালোচনার মুখে ঘটনার দুদিন পর (১৩ এপ্রিল) কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম. এম. মোর্শেদ স্বপ্রণোদিত হয়ে চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাসের নামে মামলা করেন। পরে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এই চেয়ারম্যান।