রাষ্ট্র চিন্তা বনাম নাগরিক মনোভাব

সংসারের কর্তা যায় মসজিদে কত্রী যায় ব্রহ্মচর্চায়, মেয়ে যায় সোশ্যাল ওয়ার্কে ছেলে যায় বৈরাগ্যে!
সমমনা কোনো একটি কাজও কী তারা সঠিক সময়ে সম্পাদন করতে আগ্রহী কিংবা পারস্পরিক সহায়ক হবে?। মতাদর্শগত পার্থক্যই তো তাদের এক প্লাটফর্মে সহমতে আসতে দেবে না চিন্তাগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে। প্রকৃতির নিয়মেই বরং বিরুদ্ধাচরণ করাও স্বাভাবিক বৈকি। তাহলে রাষ্ট্রীয় বহুনীতির বেলায় কী হতে পারে ভাবলে অবৈধ ভাবনা কিনা সেটাও ভাববার বিষয়। ধর্মীয়ভাবে যেটাকে হালাল বলা হয় সেটাকে আধুনিক ভাষায় বৈধ বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত বলা যেতে পারে, আবার যেটাকে হারাম বলা হচ্ছে সেটাকে অবৈধ বা লাইসেন্সহীন বলাও যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ হালাল means লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা বৈধ বা আইন সঙ্গত। হারাম means অবৈধ, দণ্ডনীয়।

এই সরল মানদণ্ডে চলুন ভেবে দেখি এবার খানিকটা।
যেমন মদ খাওয়া ধর্মের দৃষ্টিতে হারাম হলেও বিধি মেনে এর ক্রয়-বিক্রয় অবৈধ বা হারাম নয়। ১৮’র নিচে মেয়ে বিবাহ রাষ্ট্রের নীতিতে চূড়ান্তভাবে হারাম হলেও ধর্মীয় নীতিতে এ ব্যাপারে লাইসেন্স আছে ক্ষেত্র বিশেষে। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞান ইনডিভিজুয়ালি কখনোই বলতে পারবে না যে, ১৭ বছর ৩৬৪ দিনে মেয়েটার শারীরিক পরিপক্বতার ঘাটতি আছে বিবাহের উপযুক্ততার জন্য। তবুও ১ দিনের বয়সের কমতির জন্য রাষ্ট্রনীতিতে সে মেয়ের বিয়ে অনুপযুক্ত বা হারাম বা অবৈধ বলেই গণ্য হবে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মমতো শারীরিক সক্ষমতা স্থান কাল পরিবেশ ও খাদ্যমান ভেদে মোটেও চূড়ান্ত নয় বরং আপেক্ষিক।

তাহলে মাত্র এক দিন বয়সের তারতম্য ব্যক্তিগত ইস্যুতে কী এমন আসবে যাবে, যার জন্য বিবাহের বয়স ইনডিভিজুয়াল না করে একটা নির্দিষ্ট বয়সসীমাকে সামষ্টিকভাবে ফিক্সড রাখা কতটাই বা যুক্তিযুক্ত। শারীরিকভাবে তো অনেকে ২৮ বছরেও আনফিট থাকতে পারে, আবার অনেকে ১৬ তে পূর্ণ সক্ষমতা পেয়ে যায় মা হওয়ার। তাহলে যেটা হিসাব দাঁড়াল সেটা হলো, বয়স নয় বরং পুষ্টিগত ইনডিভিজুয়াল ফ্যাক্ট। এমন অনেক ব্যাপারেই প্রচলিত আইন প্রণয়নে সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলো গুলিয়ে যায় প্রায়োগিকভাবে।

যাকগে সে কথা। আসি আলোচনার দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ে। ধরুন, সাম্প্রতিক মহানবী সাঃ এর ব্যাঙ্গ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি মোতাবেক একটি দেশ সিদ্ধান্ত নেবে বিষয়টির রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ করবে কী, করবে না। কিন্তু সে দেশের নাগরিকরা যদি সে রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ না করে তাহলে?। রাষ্ট্রের নীতির বাইরে কোনো কাজ রাষ্ট্রের চোখে হারাম বা অবৈধ। কিন্তু নাগরিক মনোভাব ও আবেগ কি ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্রনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, নাকি শত সহস্র বছরের ঐশ্বরিক ধর্ম বিশ্বাস দ্বারা?। আর যে কোনো বিশ্বাসই তো কর্মকে প্রভাবিত করে সমাজিক কালচার তৈরি করে। আবার সেই সমাজই পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি সরবরাহ করে কালের পরিক্রমায় সেই ঐশ্বরিক বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত রাখে। তাহলে সমাজবদ্ধ মানুষকে পূর্বাপর প্রচলিত বিশ্বাস থেকে কীভাবে পৃথক করা সম্ভব, যেখানে ধর্মীয় নির্দেশিকা গ্রন্থ পাঠ ও সামাজিক চর্চা ইবাদত মনে করা হয় স্বর্গপ্রেম ও নরকভিতির মনছবি মস্তিষ্কে প্রগাঢ় রেখে!

রাষ্ট্র বলছে, কারো সাথে বৈরিতা নয় সবার সাথে বন্ধু প্রতীম। ধর্মীয় বিশ্বাস বলছে, সমগ্র মুসলিম উম্মা একটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মতন। তাহলে তো শুধু রাষ্ট্রনীতির অনুসারীরাই কাশ্মীরে কী হলো তা নিয়ে মাথা না ঘামানোই হালাল মনে করবে, আর ধর্মীয় নীতি অনুসারীরা জুমার নামাজ শেষে বায়তুল মোকাররম থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করাকেই হালাল এবং ইবাদতের অংশ মনে করবে এটাও তো স্বাভাবিক।

ধরুন, ফ্রান্স সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের সামরিক অভিযান তো দূরের কথা রাষ্ট্রীয় নিন্দা না থাকাও যেখানে স্বাভাবিক সেখানে আবার সাইবার আক্রমণও হচ্ছে এ দেশ থেকে শুধুমাত্র ওই ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাস ও ভাবাবেগ থেকেই। শুধু মুসলিমরাই নয়, সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও বড় একটা অংশ এপার কিংবা ওপারে চায় রামরাজ্য, সেটাও তাদের সেই ধর্মীয় ভাচবাবেগ থেকেই। তাহলে অঙ্ক বলছে, আমাদের রাষ্ট্র চিন্তা ও নাগরিক মনোভাব সমমনা নয়। ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকেও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইহুদিবাদ কায়েম করতেই ব্যস্ত তারা বায়তুল আকসার দখল নিয়ে। ধর্ম বিচ্যুত মানুষের সংখ্যা হাতের কড়ে গোনা যায় এখনো। তবুও সবচে হাস্যকর হলো, বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম না রাখা দেশের জনপ্রতিনিধিত্বের শুরুটাও হয় কোনো এক ঐশ্বরিক গ্রন্থ স্পর্শ করে নেয়া প্রতিজ্ঞায়।

বাংলাদেশের নাগরিক অধিকাংশই মুসলিম। তাই ইসলামি ভাবধারা ও বিশ্বাস তাদের কর্মে প্রতিফলিত হয়ে থাকে। সমাজ সংস্কৃতি গড়ে ওঠে সে মোতাবেকই। এখন রাষ্ট্রের কোনো একটি নীতি আদর্শ যদি সেই বিশ্বাস বা ভাবধারার সাথে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে সে ক্ষেত্রে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা খোদাদ্রোহীতার ব্যাপারে সাবধানতার প্রচার যেমন স্বাভাবিক তেমনি রাষ্ট্রপক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ঠেকানোও কর্তব্য।

এবার আসি নাগরিক মনোভাব ও রাষ্ট্র চিন্তার অমিল হলে কী হয়ে থাকে বাস্তবিকপক্ষে। যেমন ধরুন বাংলাদেশের কথাই বলি, স্বাধীনতার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তার স্বীকৃতি স্বরুপ সমাজতন্ত্রকে এ দেশের সংবিধানে প্রাতিষ্ঠানিক ঠাঁই দেয়া হয়। ঠাঁই দেয়া হয়, গণতন্ত্রের জয়জয়কার মুহূর্তেও। পাশাপাশি সহাবস্থান স্বরুপ যোগ করা হয় জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাও। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র (কমিউনিজম), জাতীয়তাবাদ (ন্যাশনালিজম), ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (সেক্যুলারিজম) ও গণতন্ত্র (ডেমোক্রেসি) সময় অসময়ে অ্যাজ লাইক অটোক্রেসি।

এই চার মাজহাব বা চারটি মতাদর্শই ঠাঁই পায় রাষ্ট্র ধর্মে (এখানে ধর্ম বলতে আমি নিয়মকানুন রীতি প্রথা ও বৈশিষ্ট্যকে বুঝি)। যার কোনোটাই হয়তো পূর্ণাঙ্গ ইসলাম নয়। এখন যেটা বুঝতে হবে তাহলো, সংবিধানে যেহেতু চারটি মতাদর্শই লাইসেন্স প্রাপ্ত বা হালাল সেহেতু এই ৪ মতাদর্শের দল থাকবে, অনুসারী থাকবে। থাকবে তাদের নিজস্ব কৃষ্টি কালচার ও বিশ্বাসের চর্চাও। রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের স্ব স্ব নীতি আদর্শ ও বিশ্বাস দ্বারাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে স্টেট অপারেশন ক্রেডিট নিয়ে তাদের মতাদর্শকে তুঙ্গে রেখে নিজেদের বিশ্বাসেই তৃপ্ত হতে চাইবে এটাও তো স্বাভাবিক।

কিন্তু প্রশ্ন হলো একই রাষ্ট্রে চারটি মতাদর্শ কি মৌলিকভাবে পুরো জাতিকে চার ভাগে বিভক্ত করে রাখে না?। রাষ্ট্র যদি হয় গুচ্ছ গুচ্ছ সমাজের সার্বিক বা সামষ্টিক রুপ তাহলে চিন্তা ও মননের যুগে
আধুনিক সমাজের সজ্ঞা এভাবে দিলে ভুল হবে না নিশ্চয়। কেবলমাত্র কিছু জনগোষ্ঠী এক জায়গায় দীর্ঘদিন বসবাস করলেই তাকে সমাজ বলা যায় না। বরং সমমনা একটি জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের একত্রিকরণকে সমাজ বলা যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, একই মহল্লায় সুইপার ও ব্রাহ্মণ পাশাপাশি বসতি হলেও আচার অনুষ্ঠানে তাদের একত্রে দেখা ভেরি রেয়ার।

তথাকথিত মুসলিম সমাজেও একই মহল্লার ১শ ঘরের মধ্যে কুরবানির গোশত জবাই ও বিতরণ হচ্ছে ১০-২০ ঘরের গুছ গুচ্ছ আকারে যার সাথে যার বনিবনা হচ্ছে তার সাথে। এর সবকিছুই হচ্ছে সমমনার ভিত্তিতে। ফলাফল বিভেদ, অশান্তি, অনুন্নয়ন। এই দুটি উদাহরণকেই জাস্ট রাষ্ট্রের চারটি মতাদর্শের সাথে মিলিয়ে দেখুন কী দাঁড়ায়। গণতান্ত্রিক দলগুলো চায় এক রকম করে সমাজ বিনির্মাণ, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুসারী চায় একই কাজ অন্যভাবে করতে, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদিরা চায় বিশেষ কোনো ধর্ম বিশ্বাসে প্রভাবিত না হোক রাষ্ট্রনীতি, আবার ধর্মীয় অনুসারীরা চায় স্বধর্মের জন্য দরকারে জীবনও দিতে।

রাষ্ট্রপক্ষ ভাবছে, বিশ্বের কোথায় কী হয়ে গেল সেটা সাংবিধানিকভাবে আমাদের কিছু আসে যায় না। পক্ষান্তরে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হলো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অধিকাংশকেই রাষ্ট্রের সে চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত করতে না পারা। মতাদর্শ দিয়ে নাগরিক চিন্তা ভাবনা প্রভাবিত করতে পারলে প্রশাসন দ্বারা সার্বক্ষণিক নিয়ন্ত্রণ প্রাকৃতিক কারণেই অসম্ভব। মি. রয়েল বলছে, সুদ ভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থায় অর্থনীতি গড়ে তোলো। অপর দিকে মি. রহিম বলছে, জাকাত ছাড়া অন্য সবকিছুকে না বলো। রিবেল বলছে, আমারটা আগে ফেলো। আবার মাঝখান থেকে সাম্যবাদী মি. রজার্স বলছে, সব সমান ভাগে ভাগ করো। কী এক আজব ব্যবস্থপনা চার পাঁচে মিলে যেন হ য ব র ল। যদিও এককভাবে হলে সবাই সবার জায়গায় সম্ভবত সঠিক স্ব স্ব মতাদর্শের পৃথক পৃথক প্রয়োগে।

তাহলে পর্যালোচনায় অনুমেয় যে একটি অগ্রসরমাণ সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন :
১. একটি জনগোষ্ঠী।
২. ওই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের ব্যক্তি মনোভাবের যোগফলের ভিত্তিতে একটিমাত্র সামষ্টিক মতাদর্শ।
৩. ওই মতাদর্শ বা নিয়ম প্রথার প্রতি সামাজিক চর্চার মাধ্যমে গভীর ভালোবাসা ও কট্টর আবেগ বিনির্মাণ।
৪. ওই আবেগ ও ভালোবাসা বাস্তবায়ন ও সংরক্ষণের জন্য ওই মতাদর্শের জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকেই উঠে আসা একটি বিজ্ঞ মহলের সমন্বয়ে দক্ষ অথরিটি/ শাসক।

তাহলে ভালো কিংবা মন্দ যাই হোক না কেন রাষ্ট্র চিন্তা ও নাগরিক মনোভাব এক বিন্দুতে কেন্দ্রিভূত হতে পারে। ডিশ এন্টেনার একাধিক চ্যানেলের একাধিক দর্শকের মতো রিমোটের টানাটানি কমবে। স্বর্গে যাক আর নরকেই যাক জাতি বহুদূরেই যাবে। আর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদই সম্ভবত রাষ্ট্র চিন্তা ও নাগরিক মনোভাবকে একবিন্দুতে আণয়নের সেই অপ্রাকৃত প্রয়াস, যা এখনো ইজরাইল ও হিন্দুস্থান, চায়নিজ কিংবা তুর্কিস্থানদের শুধু ভৌগোলিকভাবে জাতীয়তাবাদের ঝান্ডাধারী বানালেও মৌলিকভাবে বিশেষ বিশেষ স্বধর্মীয় প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত করাতে পেরেছে কিনা তার বাস্তব চিত্র আনডেসক্রাইবেবল। আমরা পারবো কি?।

লেখক : মো. আক্তারুজ্জামান
সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ ট্রেনার, এক্সিলেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার।