রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলা শুধু বাংলাদেশের দায় নয়: স্টিফেন

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক ও অন্য সব দেশকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান। তিনি বলেছেন, এ সংকট মোকাবিলা কেবল বাংলাদেশ সরকারের দায় নয়, এটা বৈশ্বিক অগ্রাধিকার। বৃহস্পতিবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

এ সময় ড. মোমেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ছাড়াও বৈঠকে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ, শিক্ষার্থীদের ভিসা সমস্যার সমাধান, বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেওয়া এবং সমুদ্র অর্থনীতি ও জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রসহ বৈশ্বিক মনোযোগ পাচ্ছে।

স্টিফেন বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র একমত যে, রোহিঙ্গাদের অধিকার পুনরুদ্ধার এবং ক্যাম্প থেকে তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের তাৎক্ষণিক মানবিক প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি সংকটের দীর্ঘস্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগ দ্বিগুণ করতে হবে। মিয়ানমার যাতে সংকট সমাধানে উদ্যোগী হয়, সেজন্য এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশের উচিত সমানভাবে স্পষ্টভাষী হওয়া। কেবল রোহিঙ্গাদের জরুরি প্রয়োজন মেটানো নয়, বাংলাদেশের কাঁধ থেকে এ বোঝা নামানোর জন্য, স্থায়ী সমাধানের জন্য বিরাজমান ইস্যুগুলোকে সমন্বয় করতে কীভাবে একসঙ্গে কাজ করা যায়, তাও বৈঠকে আলোচিত হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় স্পষ্টভাষী ছিল। একই সঙ্গে মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ এবং তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবও ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে স্টিফেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখে এবং অবাধ ও উন্মুক্ত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল’ গড়তে এই অংশীদারিত্ব আরও বাড়াতে চায়।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়ানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে দেশটির এই কূটনীতিক বলেন, মায়ামিতে বাংলাদেশ কনস্যুলেট করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটা একটি দৃষ্টান্ত যার মাধ্যমে প্রমাণ হয়, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ও বাংলাদেশি-আমেরিকানদের কল্যাণে বাংলাদেশের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়াতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন বিগান বলেন, নীতিগতভাবে এখানে কোনো বাধা নেই। তবে কভিড-১৯ মহামারির কারণে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসগুলোতে লোকবলের সংকট রয়েছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও কভিড-১৯-এর প্রকোপও এ সমস্যার একটি কারণ। টিকার মাধ্যমে কভিড-১৯-এর ব্যাপক ভিত্তিক চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হলে এ-সংক্রান্ত সমস্যা কেটে যাবে।

ঢাকা সফর সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ স্বার্থ ও সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদার করতে আলোচনার জন্যই তার এ সফর। সফরে যেসব আলোচনা হয়েছে তা অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং যৌথ অংশীদারিত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, স্টিফেনের সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরও জোর প্রচেষ্টা চালানোসহ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল দেখে থাকেন। তারা এ বিষয়টি পর্যালোচনা করছেন।

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের জোর প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক মনোভাব দেখানো হয়েছে বলে জানান ড. মোমেন। বৈঠকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে তিনি জানান।

এক প্রশ্নের জবাবে ড.মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই দিল্লির চোখ দিয়ে দেখে না। এ-সংক্রান্ত যেসব তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে, তা ভিত্তিহীন। একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় স্বার্থ ও সহযোগিতার বিষয়ে সম্পর্ক রাখে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব নীতি ও মূল্যবোধ রয়েছে। বাংলাদেশ নিজের স্বার্থের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটাই করে এবং যুক্তরাষ্ট্র সেটা খুব ভালো করেই জানে।

তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দিল্লির চোখ দিয়ে যে দেখে না, তার বড় প্রমাণ স্টিফেন বিগানের ঢাকা সফর। দিল্লির চোখ দিয়ে দেখলে তিনি ঢাকা আসতেন না। এখানে তিনি এসেছেন ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বটা আরও গভীর করার লক্ষ্য নিয়ে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এবারের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।

গত মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান। শুক্রবার সকালে তার ঢাকা ত্যাগ করার কথা রয়েছে।