নিয়ন্ত্রণহীন অনলাইন ব্যবসা

বাংলাদেশে খুবই দ্রুতই বাড়ছে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা। বর্তমান সরকারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অংশ হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যাপক উন্নয়ন, গতি আনে ই-কমার্সেও। গত ৩ বছর ধরে এ খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় একশো ভাগ। অর্থাৎ প্রতিবছর প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে এ খাত। ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, এ খাতে মাসে এখন প্রায় সাতশো কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। অর্থাৎ বার্ষিক লেনদেন এখন ৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রবৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনের বছর এটি হবে ১৬ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। অনলাইন লেনদেনে গ্রাহকদের আগ্রহ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এ খাতের উদ্যোক্তা। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অভিযোগের মাত্রাও। বিশেষ করে সময়মতো পণ্য না পাওয়া ও পণ্যের মান নিয়ে রয়েছে ব্যাপক অসন্তোষ। উদ্যোক্তারা বলছেন, ই-কমার্স বান্ধব অবকাঠামোই এখনো গড়ে তোলা যায়নি। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েই গেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ক্রেতা-বিক্রেতাদের জানা-বুঝার খাতটির কারণেও কিছু সমস্যা হয়। তাই সরকারি নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ তাদের। এখনই নজরদারি না বাড়ালে উদীয়মান এ বাজার অঙ্কুরেই ধ্বংস হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, করোনায় ঘরবন্দি জীবনে অনলাইনে কেনাকাটায় প্রচুর প্রাধান্য পেয়েছে। ডিজিটাল লেনদেনে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছে মানুষ। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণির মানুষ প্রতারণায় লিপ্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহৃত জিনিসপত্র মাস্ক, পিপিই থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন, জামা-কাপড়, ফাস্টফুড সব পণ্যেই চলছে প্রতারণা। এ প্রতারণা থেকে বাদ পড়ছেন না প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরাও।

দেখা গেছে, অনলাইনে এক ধরনের পণ্য দেখিয়ে অন্য ধরনের কিংবা নিম্নমানের পণ্য ডেলিভারি দেয়ার বিষয়টি হরহামেশা ঘটছে। আবার, কিছু কিছু পেজে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পরও পণ্য পাওয়া যায় না। এছাড়া পণ্য ডেলিভারির সময়ও প্রতারকের পাতা ফাঁদে পড়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ক্রেতারা। ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রে পণ্য ডেলিভারি নেয়ার পর দেখতে পান নিম্নমানের পণ্য দেয়া হয়েছে। তখন পণ্য ফেরত নেয়া তো দূরের কথা বরং ফেসবুকে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখা যায় আইডি ব্লক অথবা নম্বর বন্ধ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চালডাল ডট কম থেকে ৩ কেজি সাদা আপেলসহ আরো কিছু পণ্যের অর্ডার দেই। একদিন পর ডেলিভারি দেয়ার কথা থাকলেও ৩ দিন পার হয়ে যায়। ফোন দিয়ে কথা বললে তারা এখনই পাঠাচ্ছে বলে জানান। এরপর পণ্য হাতে নিয়ে দেখা গেল, বেশিরভাগ আপেল নষ্ট, ভেতরে কালো হয়ে আছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি বলে জানান এ ব্যাংকার।

শুধু চালডাল নয়; ইভ্যালি, দারাজ, প্রিয়শপ, ফাল্গুনী শপসহ বেশিরভাগ অনলাইন মার্কেটপ্লেসের বিরুদ্ধে রয়েছে ক্রেতাদের অসংখ্য অভিযোগ। অবশ্য কিছু কিছু মার্কেটপ্লেসের সেবার ক্ষেত্রে অভিযোগের পরিবর্তে প্রশংসা করেছেন ভালো সেবা পাওয়া কিছু ক্রেতা। সম্প্রতি, ‘ইভ্যালি’র বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ওঠায় প্রতিষ্ঠান? টি ও এর চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেলের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ বিষয়ে ইভ্যালির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল বলেন, আমরা লস দেয়ার জন্য ব্যবসা করছি না। এমন কিছু ব্যবসায়িক বিষয় আমরা অবলম্বন করি যা সচরাচর যেসব ব্যবসায়িক পদ্ধতি মার্কেটে চলমান তার চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। কিন্তু তার মানে এই না যে, আমরা খারাপ কিছু করছি।

ইলিয়াস হোসেন নামে একজন গ্রাহক বলেন, ঘরের বাজার-এর ভালো সেবা পেয়েছি। তাই সঠিক সময়েই পণ্য ডেলিভারি দিতে পারছে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ প্রিয়শপ ডট কমের বিরুদ্ধে। বেশিরভাগ অভিযোগে বলা হয়, কোনো কোনো পণ্য দুই মাস, এক মাস আগে অর্ডার করা হলেও ডেলিভারি দেয়া হয়নি। কিছু অর্ডারের সামান্য পণ্য ডেলিভারি দেয়া হলেও বেশিরভাগ পণ্য ডেলিভারি দেয়া হয়নি। বলা হয়েছে, এসব পণ্যের স্টক নেই, কিন্তু টাকা ফেরত দেয়া হয়নি। ফোন করা হলে একের পর এক তারিখ দেয়া হয়। চালডাল ডট কমের বিরুদ্ধে ক্রেতাদের বেশিরভাগ অভিযোগ, পণ্য স্টকে না থাকলেও চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। স্টক আউট দেয়া হয় না। ডেলিভারি ম্যান এসে বলে, এসব পণ্যের স্টক নেই। পণ্য ডেলিভারির সময় নষ্ট করে ফেলে। পণ্য দেয়া না হলেও টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে। অনলাইনে অভিযোগ করে কমেন্ট করলে সমাধান না দিয়ে তা মুছে ফেলা হয়। কম্বো অফারের নামে প্রতারণা করা হয়।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক নারী কর্মী ফেসবুক পেইজে বিজ্ঞাপন দেখে ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে ড্রেসের অর্ডার করেন। অর্ডারের ৩ দিন পর কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ড্রেসগুলো হাতে পান। প্যাকেট খুলে দেখেন, সবগুলো ড্রেসই ছিল খুব নিম্নমানের। এ সময় তিনি পোশাকগুলো ফেরত দিতে চাইলে কুরিয়ার সার্ভিসের ব্যক্তিটি নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এদিকে মোটরসাইকেলের মতো বড় অঙ্কের অর্থের পণ্য কেনাবেচার ক্ষেত্রে অনলাইনে ঘটে আরো বড় প্রতারণা। সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, প্রতারক চক্র অবিশ্বাস্য মূল্য ছাড় দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। দেড় লাখ টাকার মোটরসাইকেল তারা অফার করে ৮০ হাজার টাকা। বলা হয়, সরাসরি দেখে কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। পছন্দ হলে সেখান থেকেই মোটরসাইকেল হস্তান্তর করা হবে। প্রি-ইনস্টলমেন্ট মাত্র ৫ হাজার টাকা। এ রকম বিজ্ঞাপনে সাড়া দিলে ঘটতে পারে ২ রকম ঘটনা। প্রথমত, টাকা দিলেই ক্রেতাকে হয় ব্লক করে দেয়া হয়। অথবা টাকা দেয়ার পর সরাসরি ক্রেতাকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে যেতে বলা হয়। টাকা নিয়ে গেলে ক্রেতা ছিনতাইয়ের শিকার হন। এক্ষেত্রে অনলাইন প্লাটফরমের মাধ্যমে কেনাবেচা না করতে পরামর্শ দিয়েছে সিআইডি।

জানা গেছে, মাত্র ১ হাজার ২০০টি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হলেও অনলাইনে ব্যবসা করছে অনিবন্ধিত প্রায় ৭০-৮০ হাজার প্রতিষ্ঠান। অভিযোগের বিষয়ে ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মহাসচিব মো. আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ডেলিভারি ম্যানের সংকট রয়েছে। অনেকেই ঢাকার বাইরে চলে গেছে। আবার লকডাউনের কারণে সংগ্রহেও সময় লেগেছে, যার কারণে করোনাকালীন পণ্য ডেলিভারিতে সময় বেশি লেগেছে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নামসর্বস্ব সাইট থেকে মানুষ পণ্য কেনে, যারা ই-ক্যাবের সদস্য নয়। তাদের কাছ থেকে যখন পণ্য কেনে তখন এসব সমস্যা হয়। এর ফলে এসব অভিযোগের বিষয়ে আমরা ই-ক্যাব থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না।

তিনি বলেন, ই-ক্যাবের ওয়েবসাইটে অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি। অথবা ভোক্তা অধিকারেও অভিযোগ দিতে পারেন।

ref: bhorer Kagoj