ডাকাতি, ইয়াবা পাচারসহ খুনখারাবিতে রোহিঙ্গারা

মানবিক কারণে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসা, ডাকাতি, লুটপাটসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে রোহিঙ্গা অপরাধীরা। প্রায়ই অভিযানে আটক হচ্ছে রোহিঙ্গা। বিশেষ করে হাকিম ও জকির ডাকাতের নাম এখন সবার মুখে মুখে। এছাড়া বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের সঙ্গেও বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গা তৎপরতায় স্থানীয়রা বেজায় নাখোশ হলেও পরিত্রাণ মিলছে না।

পুলিশের একাধিক সূত্র মতে, হাকিম ও জকির বাহিনীর কাছে একে-৪৭ রাইফেলসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। তারা ১৯৯১ সালে মিয়ানমার থেকে এদেশে আসার পর একাধিক পাহাড়ে আস্তানা গেড়ে অপকর্মে লিপ্ত। হাকিমের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে হত্যা ৭টি, অপহরণ ৬টি, মাদকদ্রব্য আইনে দুটি, ডাকাতি দুটি ও একটি ধর্ষণ মামলা উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ১৬ মে নয়াপাড়া আনসার ক্যাম্পে হামলা করে কমান্ডারকে খুন করে ১১ অস্ত্র ও ৬৭০ রাউন্ড গুলি লুটের ঘটনাও রয়েছে। রাখাইনের মংডু বড়ছায়ার জয়নাল আলীর পুত্র হাকিমের আপন চার ভাইসহ বাহিনীর ১১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে অস্ত্র, গুলি। আরেক ডাকাত জকিরের নামেও এক ডজন মামলা রয়েছে। মারিসবুনিয়া পাহাড় থেকে একাধিকবার উদ্ধার হয়েছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের পোশাক। এসব পরিধান করেই তারা ডাকাতিতে অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে লেদা, নয়াপাড়া, কুতুপালং, বালুখালীসহ সবকটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। মাদক বহনকারী থেকে ইয়াবা ব্যবসায়ী হয়ে ওঠা রোহিঙ্গার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কাছে অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছে রোহিঙ্গা নারী, কিশোর ও পুরুষরা। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবা কারবারিদের তালিকায়ও রয়েছে ১৩ জন নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম। রোহিঙ্গারা আসার পর মেথাফেটামাইন ও ক্যাফেইনের মিশ্রণে তৈরি ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭-২০ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। এসব মামলায় চার বছরে কয়েকশ’ আসামি ধরা পড়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তালিকায়ও রয়েছে রোহিঙ্গাদের নাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের নাফ নদীর সব পথ চেনা। স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে তারা নানা কায়দায় নিয়মিত ইয়াবার চালান হাতবদল করছে। নদীর ওপারে-এপারের রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক গেড়েছে অনেক মাদক ব্যবসায়ী। সবকটি ক্যাম্প মিলিয়ে শতাধিক রোহিঙ্গা এর সঙ্গে জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। গত দুই বছরে অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা আটক হয়েছে ইয়াবাসহ। ২০১৮ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশ্যে লেদার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা প্রহরী মোহাম্মদ আবু ইয়াছেরকে (২২) বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ইয়াবা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এই হত্যাকা- ঘটেছে। স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিবাদ এখন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

র‌্যাব-১৫ ব্যাটালিয়ন, টেকনাফ ও উখিয়া পুলিশের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নানা কায়দায় রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে বের হয়। তারা ইয়াবা ব্যবসাসহ নানাবিধ অপরাধে জড়িত। গত তিন বছরে নতুন আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ২৫ জন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। এ ঘটনায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ডাকাতি, মারামারি, চুরি, চোরাচালান, মাদক মামলা ও ধর্ষণ মামলাও রয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা। ২০১৬ সালে টেকনাফ উপজেলা থেকে উদ্ধার করা ইয়াবার মোট পরিমাণ বলা হয় দেড় কোটি। ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ইয়াবার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় দুই কোটিতে। ২০১৮ সালে এই পরিমাণ আড়াই কোটি ছাড়িয়ে যায়। উখিয়ার চিত্রও অভিন্ন। ২০১৯ ও চলতি বছরের ৭ মাসে ওই এলাকা থেকে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ৫ কোটির অধিক। সর্বশেষ গত ২৩ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যায় কক্সবাজারে একটি মাছ ধরার ট্রলার থেকে ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার এবং এক রোহিঙ্গাসহ দুইজনকে আটক করেছে র‌্যাব। সদরের খুরুশকূল মাঝিরঘাট এলাকা থেকে ইয়াবাগুলো উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলেন- উখিয়ার বালুখালী ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এইচ-১৬ ব্লকের বাসিন্দা মো. বশির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আয়াজ (৩৪) ও কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের দক্ষিণ হাজীপাড়ার মৃত আব্দুল মজিদের ছেলে মোহাম্মদ বিল্লাল (৪৫)। ট্রলারে তল্লাশি করে ১৩ লাখ ইয়াবাসহ নগদ ১০ হাজার ৯০০ টাকা, ১টি মোবাইল ফোন ও ১টি সিম কার্ড উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া ইয়াবার আনুমানিক বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা।