সংঘর্ষ নয়, পিটিয়ে তিন কিশোরকে হত্যা: হাত-পা-মুখ বেঁধে পেটায়, দেখানো হয় ক্রসফায়ারের ভয়

কিশোরদের দুই পক্ষের ‘সংঘর্ষে নয়’, কর্মচারীদের ‘মারধরে’ যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন কিশোরের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। আর এ অভিযোগে রয়েছে যৌক্তিকতা বলে মনে করছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উর্দ্ধতন কর্মকর্তাগণ। আহতরা বলছে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মকর্তা এবং তাদের নিয়োজিতরাই শিশু-কিশোরদের বেদম প্রহর করে। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত তাদের হাত-পা-মুখ বেঁধে দফায় দফায় মারধর করেছে। অচেতন অবস্থায় তাদের ফেলে রাখা হয়। সে কারণে বিনা চিকিৎসায় তাদের তিনজন মারা যায়। এক কর্মকর্তা কিশোরদের ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখান বলেও অভিযোগ করেছে তারা। এতে আহত হয় অন্তত ১৫ জন। এ ঘটনায় ঘটনায় এখনও মামলা হয়নি তবে, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ১০ কর্মকর্তাকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। কেন্দ্রটি বর্তমানে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

এদিকে, মৃত্যুর সংবাদ পর্যন্ত কেন্দ্রের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। খবর দেখে ছুটে এসেছে নিহত ও আহতদের স্বজনরা। এ তিন খুনের ঘটনায় স্বজনরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তারা শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন। শুক্রবার সকালে কেন্দ্রের সামনে স্বজনদের অবস্থান ও কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। তাদের আহাজারিতে শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কেন্দ্রের নৃশংস এ ঘটনার সূত্রপাত হয় গত ৩ আগস্ট। এদিন, কেন্দ্রের প্রধান নিরাপত্তা কর্মী নূর ইসলাম কয়েকজন কিশোরকে তার মাথার চুল কেটে দিতে বলেন। এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ওই নিরাপত্তা কর্মী পরিচালকের কাছে কিশোরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, তারা মাদকাসক্ত। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বন্দিদের কয়েক জন নূর ইসলামকে মারপিট করে। এ ঘটনার জের ধরেই শেষ পর্যন্ত সংশোধনের জন্য আনা শিশুদের উপর চালানো হয় মধ্যযুগীয় নির্যাতন।

আরও পড়ুন:
যশোর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে কিশোরের মৃত্যু, পরিবারের দাবী পরিকল্পিত হত্যা
বিবাহ বিচ্ছেদ হলো কঙ্কনা সেন শর্মা ও রণবীরের
দেশের ১৭ অঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টির সম্ভাবনা

আহতরা জানান, কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মাসুদের ইন্ধনে আনসার সদস্য ও ১০/১২ জন বন্দি তাদের বেদম মারপিট করে। মারপিট শুরু হয় দুপুর ১২ টাকা থেকে। চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। এতেই খুলনার দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা পশ্চিম সেনপাড়ার রোকা মিয়ার ছেলে পারভেজ হাসান রাব্বি (১৮), বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার মহিপুর গ্রামের আলহাজ নুরুল ইসলাম নুরুর ছেলে রাসেল ওরফে সুজন (১৮) এবং একই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার তালিপপুর পূর্বপাড়ার নানু প্রামাণিকের ছেলে নাঈম হোসেন (১৭) মারা যায় এবং আহত হয় ১৫ জন। এদের মধ্যে ১৪ জনকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

খুলনা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি নাহিদুল ইসলাম বলেন, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ২ পক্ষের সংঘর্ষে নয়, যারা আহত ও নিহত হয়েছে তারা এক পক্ষের হাতেই মারপিটের শিকার হয়েছে। এ ব্যাপারে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটিও হতে পারে। তখন পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এখনও কেউ কোনো লিখিত অভিযোগ দেয়নি। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন বাদী যে কেউ হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজন বা তৃতীয় কোনো পক্ষও হতে পারে। কাউকে না পাওয়া গেলে পুলিশ মামলা করবে।

অন্যদিকে, সমাজসেবা অধিদপ্তর দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তিন কর্মদিবসের মধ্যে এ কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের পাশাপাশি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবেন বলে জানিয়েছেন যশোরের জেলা প্রশাসক মো. তমিজুল ইসলাম খান।

যশোরের এ কেন্দ্রে লাশ উদ্ধার ও মারধরের ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। দায়িত্বে অবহেলা ও দূর্নীতির অভিযোগ ওঠায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি প্রতিষ্ঠানটি সুষ্ঠুভাবে চালানোর জন্য সুপারিশও করেছিল।

বিভিন্ন মামলায় ১৮ বছরের নিচের সাজাপ্রাপ্ত বালকদের জন্য দেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। যার একটি গাজীপুরের টঙ্গিতে, অন্যটি যশোর শহরতলীর পুলেরহাটে। এ কেন্দ্রে মোট বন্দির সংখ্যা ২৮০জন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রের সহকারী পরিচারক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ।

এদিকে, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রট হাফিজুল হকের উপস্থিতিতে শুক্রবার দুপুরে যশোর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তার আহম্মেদ তারেক সামস নিহত তিন কিশোরের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছেন।

আরও পড়ুন:
বাংলাদেশে ভারতের নতুন হাইকমিশনার বিক্রম কুমার
কোটচাঁদপুরে পানিতে ডুবে নিখোঁজ দুই মাদ্রাসা ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার
ঠাকুরগাঁওয়ে ঐতিহ্যবাহী জামাই কনের শুরু হয়েছে ভাদর কাটানির মহা আনন্দ

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক সার্কেল) গোলাম রব্বানী শেখ জানান, এই ঘটনায় শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, সহ-তত্ত্বাবধায়ক মাসুম বিল্লাহ, প্রবেশন অফিসার মুশফিকুর রহমান, শারীরিক প্রশিক্ষক শাহনূর রহমানসহ কেন্দ্রে কর্মরত ১০ জনকে শুক্রবার ভোরে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। কেন্দ্রে তাদের রাখা ঝুঁকিপূর্ণ এবং মূল ঘটনার কারণ জানতে সমাজসেবা কর্মকর্তাদের পরামর্শে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তারা বর্তমানে যশোর পুলিশ লাইনসের ব্যারাকে রয়েছেন।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের ৩ কিশোর নিহত ও ১৪ জন আহত হয়। ঘটনার পর কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, সংশোধনের জন্য রাখা শিশু-কিশোরদের ২টি গ্রুপের সংঘর্ষে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এত বড় ঘটনা ঘটলেও কর্মকর্তা বিষয়টি সন্ধ্যা পর্যন্ত চেপে থাকায় সবার মনে সন্দেহ হয়।

১১ আগস্ট, ২০২০ at ২২:৩১:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/আক/তআ