করোনা জয় ও চিকিৎসক ঊষার গল্প

‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’ -এমন কথা আজ কাল্পনিক কথা বলেই মনে হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যদি মানুষের হৃদয়ে মায়া মমতা বিচার বিবেক জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি না করতো তবে ইতিহাসের পাতায় এসব কথা লেখা হতো না । আর এ মূল্যবান কথাটির যথার্থ খুঁজে পাওয়া যায় ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষার জীবনাদর্শে। তিনি সদ্য করোনা ভাইরাস জয় করে আবারও ফিরে এসেছেন তার মহান পেশায়।

ডাঃ ঊষা খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রন) হিসাবে কর্মরত রয়েছে। তিনি শুধু একজন কর্মঠ চিকিৎসকই নন। একজন কন্ঠ শিল্পী ও একজন কবিতা লেখকও । এত কিছুর পরও ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা চিকিৎসা সেবাকে সব চেয়ে বড় করে দেখছেন। তবে জীবন যুদ্ধে থেমে থাকেনি তিনি। সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন এই চিকিৎসক।

চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা।

যশোর জেলার মথুরামপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন ডাঃ ঊষা। বাবা শেখ আব্দুল সামাদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী। মাতা রওনাক রায়হানা রিনা একজন গৃহিনী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান ঊষা। ছোট ভাই মিরপুর ক্যান্টনমেন্টে লেফটেন্যান্ট হিসাবে কর্মরত। অষ্টম শ্রেনীতে পড়া-শুনা করে ছোট বোন। তিন বছর বয়সে ছবি আকার মাধ্যমে ছড়াতে থাকে তার প্রতিভার আলো। পাঁচ বছর বয়স থেকে আবৃত্তি, বিতর্ক ও গান গাওয়া শুরু হয়।

ছবি আকায় ১১টি আন্তর্জাতিক ও বারোবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি । নতুন কুড়ি , জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে স্বর্ণ ও রৌপ্য অর্জন করেছেন এই চিকিৎসক। আর এ সব কিছুর জন্যই মা রিনার অবদান অনেক বেশী। মায়ের কাছ থেকে ঊষার প্রথম হাতে খড়ি ছিলো। সপ্তম শ্রেনীতে পড়া অবস্থায় বিটিভির আলোর শতদল ও বাংলাদেশ বেতারে প্রবেশ করেন তিনি । অষ্টম শ্রেনীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে যশোর বোর্ডের প্রথম স্থান অধিকার করেন।

আরও পড়ুন:
ব্যক্তি অপরাধের দায় সমগ্র পুলিশ বাহিনীর উপর চাপানো হচ্ছে কেন?

যশোর দাউদ পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এস এস সি ও এইচ এস সি পরীক্ষায় এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন । এর পর খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে তিনি এমবিবিএস পাশ করেন। ২য় প্রফেশনাল পরীক্ষায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নবম স্থান অধিকার করেন ঊষা। এমবিবিএস পাশ করার পর ইন্টার্নীর সময়েই তিনি খুলনায় সংস্কৃতি অঙ্গনে প্রবেশ করেন।

যশোর সদর মেডিকেল অফিসার (মেটারনিটি এন্ড চাইল্ড হেলথ), পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে তার প্রথম কর্মজীবন শুরু হয়। এর পর খুলনা জেলার ফুলতলা হয়ে গেল মার্চ মাসে খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে মেডিকেল অফিসার রোগ নিয়ন্ত্রন পদে যোগদেন তিনি। খুলনায় যখন ব্যাপক করোনা ভাইরাসের প্রভাব ডাঃ ঊষা একনিষ্ঠ ভাবে দায়িত্ব পালন করতে থাকে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি। সেই সাথে নিজেকে সাজাতে ভুলে যান না তিনি। তার অপরুপ চেহারাটাকে আরো ফুটিয়ে তুলতে কিছু সময় ব্যায়ও করেন ঊষা। এর পর অফিসে এসেই খুলনা মেডিকেল কলেজ, হাসাপাতাল, সদর হাসাপাতাল, করোনা হাসাপতাতালসহ প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার যোগাযোগ করতে হয়। তথ্য সংগ্রহ করে দুপুর ১২টার মধ্যে করোনা প্রতিবেদন তৈরী করেন তিনি। পরে বিকাল ৪টার মধ্যে ঐ প্রতিবেদনটি গ্রাফিকসের মাধ্যমে জেলা প্রশাসক কার্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী দপ্তারে প্রেরন করেন। তিনিএ ভাবেই বিরতিহীন ভাবে কাজ করতে থকেন।

দেশ দর্পণে‘র সাথে একান্ত সাক্ষাত দিচ্ছেন শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা।

কর্মের মধ্যদিয়েই খুলনায় মিডিয়া কর্মীদের কাছে নতুন করে পরিচিতি পায় ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা। দেশের জন্য যে ভাবে তার বাবা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে ছিলো। ঠিক তেমনি বাবার মত করোনার সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে বেশ কিছু দিন। গত ২৭ জুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন । ঐদিনই তাকে খুলনা করোনা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া অবস্থায় অন্য রোগীদের কাছে ছুটে গিয়েছেন তিনি। নিজে রোগী হয়েও সেখানে অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ভুল করেনি তিনি। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর ১১ জুলাই উষার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। সুস্থ্য হয়ে ফিরে যান নিজ কর্মস্থলে। ডাঃ ঊষা নিজে করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, অন্যদের চিকিৎসা সেবাও দিয়েছেন। পিছু হটেননি তিনি। সর্বশেষ নিজের পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দকে বির্ষজন দিয়ে ঊষা সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগকে।

কন্ঠ শিল্পী, কবিতা লেখক ও চিকিৎসক ঊষা গান করেছেন বেশ কয়েকটি বেসরাকারী টিভি চ্যানেলেও। বর্তমানে তিনি খুলনা বেতারের নিয়মিত শিল্পী। খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার (রোগ নিয়ন্ত্রন) ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা বলেন, আতঙ্কিত হইনি । যুদ্ধ করতে নেমে একটুও আক্রান্ত হবো না তা কি হয় ? উপসর্গ গুলোর তীব্রতা বিবেচনা করে হাসপাতালে আইসোলেশনকে উত্তম বলে বেছে নিলাম।

দীর্ঘ চার মাস কন্ট্রোল রুমে টানা ডিউটি করার পর হাসপাতাল ও রোগী দেখে মনে হল ঠিক জায়গায় এসেছি।এই হাসপাতালটি যখন রোগীদের জন্য বিবেচনা করা হয় তখন অনেকবার পরিদর্শনে এসেছি । আইসিউ বেড গুলো যখন এসেছে তখন দেখি গেছি। পার্থক্য হল এগুলো এখন করোনা রোগী দ্বারা সব পরিপূর্ণ।

ডাঃ ঊষা আরো বলেন, করোনা হাসপাতালে ভর্তির ৪/৫ দিন পার হওয়ার পর মনে হল আমি নাইট ডিউটিতে আছি। রোগী অসুস্থ। আমাকে যেতে হবে। আমি দশ কদম যেতে যেতে দেখি রোগীর পিপিই পড়ে আত্মীয়র ওখানে উপস্থিত হয়েছেন। সিস্টারও চলে এসছেন ততক্ষণে। কিন্তু আমার বার বার মনে হচ্ছে আমাকে যেতে হবে। মনে হচ্ছে এখন রাউন্ড শুরু করতে হবে।

আমি তো ডাক্তার !! একটি রোগীর আওয়াজ শুনে আমি নিজে এগিয়ে গিয়েছিলাম । আমাকে রোগীর সাথে কথা বলতে হবে। অনেক দুর্বল এই শরীরটা নিয়ে কিভাবে এত দ্রুত গেলাম জানিনা। আমাকে তখন রোগী হিসাবে মনে করিনি, নিজেকে ডাক্তার হিসাবেই মনে করেছি। দুইবার চাচা বলে ডাকতে ছানি পড়া দুই চোখ পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বুঝলাম এইবার ওষুধে কাজ হবে। ডাকটা হয়তো তার মনে পৌঁছে গেছে। পরে জানলাম উনি মুক্তিযোদ্ধা। জীবনে হাজার যুদ্ধ পার করে এসেছেন।

একজন আদর্শবান বাবার সন্তান হিসাবে মানুষের জন্য সু-চিকিৎসায় নিজের দায়িত্ব একনিষ্ঠ ভাবে পালন করতে চান ডাঃ শেখ সাদিয়া মনোয়ারা ঊষা।

১২ আগস্ট, ২০২০ at ২২:৫৪:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/বাআ/তআ