কেন হারিয়ে যায় ভালোবাসা

ভালোবাসার মানুষ যখন পাশে থাকে পৃথিবীটা মনে হয় স্বর্গ। যখন দুজনের বোঝাপড়া ভালো ও মধুর হয়, তখন পৃথিবীতে পাওয়া যায় স্বর্গীয় সুখ। ভালোবাসায় যখন দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তখন আপন মানুষটা দূরের মানুষের মতো ব্যবহার করে। তখনই পৃথিবীটা নরক হয়ে ওঠে। আপনি চাইলেও সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার শুরু, যার শেষ সমাপ্তি বিয়ে পর্যন্ত। কিন্তু এই স্বর্গতুল্য সম্পর্ককে আগলে রাখার দায়ভার কার- নারী না পুরুষের? উত্তর দু’জনেরই। তাই ভালোবাসার মানুষকে প্রচুর সময় দিন। তাকে বুঝতে চেষ্টা করুন। তার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করুন। তবেই সম্ভব হবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। কিন্তু কৌশলগত দিক থেকে এই দায়িত্ব-কর্তব্য ও বোঝাপড়াগুলো দু’জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উভয়েরই মনে রাখা উচিত, একতরফা সম্পর্ক হয় না। এজন্য দায়িত্ব নিন দু’জনেই।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা ও ভাঙনের সমস্ত দায়িত্ব একজনের ওপর ছেড়ে দিই। একজন অপরজনের দোষারোপ করি। আপনিই ভাবুন, একটি সম্পর্ক কী করে একজন সামলে নেবেন? বাকি যিনি থাকবেন তার কোনো রেসপনসিবিলিটি, সেনসিবিলিটি ও যতেœর প্রয়োজন নেই? যদি না-ই থাকে, তাহলে তা সম্পর্ক নয়। আপনি কর্মজীবী, আপনার সঙ্গীও তাই। কর্মক্ষেত্র ছাড়াও আপনাদের উভয়েরই পরিবার, বন্ধু ও অন্যান্য সামাজিক কিছু সম্পর্ক রয়েছে। দু’জনের দিক থেকেই এ বিষয়গুলোকে ছাড় দিন। লক্ষ্য করুন, আপনার আচরণে আপনার সঙ্গী এসব সম্পর্ক সহজভাবে সচল রাখতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন কিনা। যদি তিনি আপনাকে এ বিষয়ে ছাড় দিতে পারেন তাহলে আপনিও ছাড়দিন। যদি আপনি তাকে চাপে রাখেন, তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধার কারণ হন, তাহলে একটা সময় পর আপনার সহজ বিষয়গুলোকেও আপনার সঙ্গীর কাছে কঠিন হয়ে ঠেকবে। তৈরি হবে তুলনাবোধ। তার মনে হবে- তিনি আপনাকে ছাড় দিচ্ছেন, তবে আপনি কেন নন? মিথ্যা বলা মহাপাপ, যা আমরা সকলেই জানি। আশ্চর্যের ব্যাপার কিছু কিছু সময় আপনার ছোট ছোট মিথ্যা সম্পর্কের রশিকে ঢিলা করে দেয়। এছাড়া তার কাজের হিসাব ও স্বাধীনতা বলতে একটি ব্যাপার আছে। তাই অযথা প্রিয় মানুষটির কাছে সব কাজের হিসাব চেয়ে সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলবেন না।

সর্বময় ক্ষমাশীল হয়ে উঠুন। ক্ষমা করা সহজ কিন্তু ভুলে যাওয়া কঠিন। স্মৃতি ভীষণ স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার, তাই চাইলেই ভুলে যাওয়া যায় না। দেখা যায়, আপনার খুব অপছন্দের মানুষকেও আপনি ভুলে যেতে পারছেন না, কারণে অকারণে বার বার কোনো না কোনো কাজের ভেতর দিয়ে আপনার অপছন্দের মানুষগুলো ফিরে আসছে। তাহলে ভেবে দেখুন, যেখানে নিতান্তই অপ্রিয় মানুষগুলোকে আপনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যেতে পারছেন না, সেখানে খুব প্রিয় মানুষটিকে কী করে ভুলে যাবেন? ক্ষমার অপর নাম মুক্তি। আপনি সেই মানুষটিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন মানে আপনি নিজে নিজের কাছে সম্পূর্ণরুপে মুক্ত হয়ে গিয়েছেন। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সাধারণত আমরা যে জিনিসটি করি, তা হলো খুব বেশি অস্থির হয়ে পড়ি, একটি সম্পর্ক ভাঙার হতাশা থেকে বের হতে না হতেই আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। আমরা ধরেই নেই যে, প্রিয় মানুষটি ছেড়ে চলে গিয়েছে মানেই আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। একাকীত্ব ও নিঃস্ব অবস্থা যত দ্ররূত দূর করা যায় ততই মঙ্গল।

প্রিয় মানুষটিকে মাত্রারিতিক্ত সন্দেহে সম্পর্ক বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ। আপনি কি জানেন একটা সম্পর্ক শুরু হয় একে অপরের প্রতি অগাধ বিশ্বাস দিয়ে। সেই বিশ্বাসের খুঁটি যখন নড়বড়ে হয়ে যায়, তখন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই মুশকিল। ভয় নয় প্রিয় মানুষটির আশ্রয় হোন। বর্তমান সময়ে সম্পর্ক ঠিক থাকার চেয়ে ব্রেক-আপের সংজ্ঞা বেশি স্পষ্ট। ভালোবাসার যুগলদের কাছেই সম্পর্কের যেকোনো সমস্যার একমাত্র সমাধান হচ্ছে ব্রেক-আপ। আপনি কি আপনার সঙ্গীর যেকোনো ভুল, আচরণ বা ঘটনার কারণেই ব্রেক-আপের হুমকি ছুঁড়ে দিচ্ছেন বা তিনি দিচ্ছেন আপনাকে? যদি নিজেদের মধ্যে সমস্যা থাকে তাহলে সেটা নিজেরাই মিটিয়ে নিন। ব্রেক-আপ করলে হয়তো একটি সম্পর্কের অবসান হবে, কিন্তু আদো কি সুখী হওয়া সম্ভব? হোক একটু ঝগড়া, কথা কাটাকাটি, মান-অভিমান। সময় নিন, আপনাআপনিই সব ঠিক হয়ে যাবে।

যদি ভালোবাসা সত্যিই থাকে, তবে মিটে যাবে সব। একসঙ্গে থাকবেন এটা যদি লক্ষ্য হয় তবে এসব ঝগড়া, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে কথা কাটাকাটির একসময় অবসান হয়ে যাবে। এটা নিশ্চিত। আর যদি এটা মাথায় থাকে যে, যেকোনো বিষয় নিয়ে লাগলেই ছেড়ে দেবেন বা ছেড়ে যাবেন, তাহলে নিশ্চিত কোনোদিনও সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ মনে আশঙ্কা থাকবেই যে পাশের মানুষটি ছেড়ে যাবে একদিন। অযথা প্রিয় মানুষটিকে দোষারোপ করবেন না। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দোষারোপ করবেন না। ভুল সবারই হয়, ক্ষমা করুন। আর যদি আপনার ভুলের জন্য সে আপনাকে দোষারোপ করে তাহলে ক্ষমা চেয়ে নিন। সম্পর্কটাই যদি মূখ্য হয়, তবে ক্ষমা চাইতে বা করতে ক্ষতি কী।

তবে এখানেও কথা আছে- আপনি কী চান সম্পর্কটা নিয়ে? যদি নিতান্ত ওই ব্যক্তিটিকেই আর সহ্য না হয় বা ভালোলাগা কেটে যায় অথবা নতুন কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তাহলে ভিন্ন বিষয়। এজন্য তার ব্যক্তিগত আইডি যেমন ফেসবুক, ই-মেইল সবার মধ্যেই কিছু কিছু গোপনীয়তা থাকে, যা কখনও কাউকে বলা যায় না। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটিকেও না। তার গোপনীয়তা তার মধ্যেই থাকতে দিন। সেক্ষেত্রে নতুন সম্পর্ককে আমন্ত্রণ জানানোর খাতিরে বর্তমান সঙ্গীর সঙ্গে নেতিবাচক আচরণ বা তাকে অহেতুক দোষারোপ না করে সরাসরি বলে দিন সত্যটা। অযথা সব ব্যাপারে নাক গলাবেন না সম্পর্কের সমস্ত অসময়ের দোষ তার কাঁধে চাপাবেন না। এতে সম্পর্কের মধ্য থেকে বিশ্বাসই উঠে যায়।

ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঠিক না, এধরণের কথা এড়িয়ে চলুন। এক্ষুণি তোমাকে এটি করতে হবে- আদেশের সুরে কথা না বলে অনুরোধের সুরে কথা বললে কাজ বেশি হয়। যখন আপনি তাকে বেশি আদেশ করবেন, তখন সে ভেবে নেবে আপনি তাকে তুচ্ছজ্ঞান করছেন। যার দরুণ, আপনার থেকে তার ভালোবাসা ওঠে যাবে। তার সব কথায় না বুঝে সায় দেওয়া ঠিক না। অনেকে আছেন, এমন ভাবেন যে- আমার কাছের মানুষ কি ভুল বলতে পারে নাকি? তাই তার সব কথা না বুঝে না শুনে শুধু হয়, হয় করেন।

আপনি জানেন, এতে আপনার সঙ্গী চরম বিরক্তিবোধ করেন। তিনি চান, আপনি তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনুন, এর পর ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিন। সুখী হওয়াই মূখ্য, ভাঙন নয় এটা বিশ্বাস করা সম্পর্কের মূলমন্ত্র। চিরদিন সুখী হয়ে একসঙ্গে বাঁচার নাম ভালোবাসা। নারী-পুরুষ উভয়েরই স্বাধীনতাবোধ রয়েছে। স্বাধীন চিন্তা ও নিজের একটি স্বতন্ত্র জগত রয়েছে প্রতিটি মানুষেরই। ভালোবাসার সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত যা পরস্পরের স্বাধীনতা, মূল্যবোধ ও সম্মানের স্থানগুলোকে অক্ষত ও সুরক্ষিত রাখবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক