হামলার ভয়ে ৬০ পরিবার গ্রাম ছাড়া

একটি হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে বাদী পক্ষের লোকজনের হামলার ভয়ে একটি গ্রামের ৬০ পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে জনশূন্য হয়ে পড়া ওই এলাকাটিতে এখন ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিণত হয়েছে বিরাণভূমিতে। পরিবারগুলো বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘটনাটি কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার রিফায়েতপুর ইউনিয়নের হরিণগাছি মোল্লাপাড়া গ্রামের।

সরেজমিনে গিয়ে গ্রামটিতে প্রায় জনশূন্য অবস্থা দেখা যায়। সেখানকার অন্তত ৬০টি পরিবারকে তাদের নিজ নিজ বাড়িতে পাওয়া যায়নি। মাসখানিক আগে ওই গ্রামে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শামীম মালিথা নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার ২২ আসামির পরিবারসহ ৬০টি পরিবার গ্রাম ছাড়া হলেও অপরাপর গ্রামবাসীও এ বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। ওই ৬০ পরিবারের নারী ও শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউই এখন বসতবাড়িতে নেই। রয়েছে শুধু ভাঙচুর তাণ্ডবের চিহ্ন।

সাংবাদিকদের উপস্থিতির কথা শুনে আশেপাশের এলাকা থেকে বেশ ক’জন নারী এসে মুখোমুখি হন। তারা আসামি পক্ষের পরিবারের সদস্য। এ সময় তাদের চেহারায় স্পষ্ট অাতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারীরা জানান, এসব ফাঁকা বাড়িঘর তাদের। গ্রামে মার্ডার হওয়ার পর থেকে তারা নিজেদের বসতবাড়িতে আর আসতে পারেননি। কখনো গোপনে নিজেদের বাড়িঘরে আসলেই সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য বাদী পক্ষের লোকজন ছুটে আসেন। এ কারণে ভয়ে এখন তারা বাড়িতেই থাকছেন না। আশ্রয় নিয়েছেন আশেপাশের গ্রামে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে।

আরও পড়ুন:
চৌগাছায় বাঁশের সাকো ভেঙ্গে যাওয়ায় জনদূর্ভোগ চরমে
নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবই নয়
করোনা যাত্রী-মালিক-শ্রমিক আলাদা করে চিনবে না: কাদের

ভুক্তভোগী ওই নারীরা অভিযোগ করেন, মার্ডার পরবর্তী সময় হামলার ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এই সুযোগে তাদের বসতবাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়েছে। ওই গ্রামের স্বাধীন আহম্মেদ, দিনু মেম্বার ও পাশের রিফায়েতপুর গ্রামের ফারুক আলম পান্নার লোকজন এসব বাড়িঘরের মালামাল ও গরু ছাগলসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুই লুটপাট করেছেন। একইসাথে জানালা-দরজা খুলে নিয়ে গেছেন। অন্যান্য জিনিসপত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে বলেও তারা জানিয়েছেন।

বসতবাড়ির জানালা-দরজা খুলে নেয়া হয়েছে। ছবি: দেশ দর্পণ

আসামি পক্ষের লোকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাদী পক্ষের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে এসব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তারা। এ বিষয়ে অভিযুক্ত স্বাধীন আহম্মেদ বলেন, আমাদের লোকজন তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত নন। বরং তারা (আসামি পক্ষ) নিজেরাই নিজেদের মালামাল সরিয়ে নিয়ে গেছেন। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ২২ জন, সেক্ষেত্রে একটি গ্রামের ৬০টি পরিবারের মানুষ এলাকা ছাডা় কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বাধীন বলেন, আমরা কখনো কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি। তারা অপরাধ করেছে তাই ভয়ে নিজে থেকে এলাকা ছেড়েছে।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আলম পান্না বলেন, আমার বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে, আমি লুটপাট ভাঙচুরের বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারবো না। তবে আসামি পক্ষের লোকজন কাউন্টার মামলা করার জন্য নিজেরা ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে শুনেছি। পান্না বলেন, আগামী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমি চেয়ারম্যান প্রার্থী। এ কারণে হত্যা মামলার এক নম্বর আসামি বর্তমান চেয়ারম্যান বাবু আমাকে জড়িয়ে ইমেজ ক্ষুণ্ন করার লক্ষে এ ধরনের অপপ্রচার করছেন।

কাঁচা ঘরের দেয়াল ভেঙে তছনছ করা হয়েছে। ছবি: দেশ দর্পণ

এ ব্যাপারে রিফায়েতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জামিরুল ইসলাম বাবুর সাথে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইল ফোনে কল দেয়া হলে অন্য এক ব্যক্তি রিসিভ করেন। পরে অজ্ঞাত স্থান থেকে মোবাইল ফোনে চেয়ারম্যান জামিরুল ইসলাম বাবু অভিযোগ করেন, ওই গ্রামটিতে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়েছে। বাড়িঘর ভাঙচুর ছাড়াও লুটতরাজ করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাদী পক্ষের ভয়ে পালিয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর প্রায় দুইশ গরু ছিল। কিন্তু সব গরু তারা নিয়ে যেতে পারেননি। ৩২টি গরু লুট করা হয়েছে। এ সময় চেয়ারম্যান বাবু বলেন, অন্যায়ভাবে আমাকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে।

দৌলতপুর থানার ওসি এসএম আরিফুর রহমান জানান, শামীম হত্যা মামলার এজাহারনামীয় ৬ আসামিকে ইতোমধ্যে আটক করা হয়েছে। অন্য আসামিদের আটকের জন্য তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে ঘটনার দিন থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টাই গ্রামটিতে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। তবে আসামিদের বাড়িঘরে হামলা ভাঙচুর সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ পুলিশের কাছে আসেনি। সুতরাং কারো পক্ষ নেয়ার প্রশ্নই আসে না।

প্রসঙ্গত, গত ৬ মে উপজেলার রিফায়েতপুর ইউনিয়নের হরিণগাছি গ্রামে একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শামীম মালিথা (২৫) নামে এক যুবক নিহত হন। ঘটনার পরের দিন নিহত শামীমের বাবা মেহের বকস মালিথা বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় একটি মামলা করেন। রিফায়েতপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামিরুল ইসলাম বাবুকে প্রধান আসামি করে ২২ জনের নামে হত্যা মামলাটি দায়ের করা হয়। এরপর থেকেই আসামি পক্ষের লোকজনসহ ৬০টি পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়েছেন।

জুন ০২, ২০২০ at ২০:১৯:৪২ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আক/এসআরএস/তআ