কেন টসে জিতে পুলিশকে বেটিং-ই করতে হবে?

বেশ কিছুদিন ধরেই মৌসুমী জ্বরের জন্য অসুস্থতা বোধ করছি। এর মধ্যেই দেশব্যাপী করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের জন্য স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইন মেনে দিন পার করছি। এর মধ্যেই দুদিন আগে কথা হলো আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের সাথে। আমার অসুস্থতার খবর শুনে সে বললো, “স্যার আপনার সুস্থ হয়ে উঠা প্রয়োজন। আপনার যদি কোন কিছুর দরকার হয় তাহলে আমাকে বলবেন, আমি আপনার বাসায় পৌঁছে দিব।“ ছাত্রের এই দায়িত্বশীল আচরণে আমি মুগ্ধ হলাম। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে মনে মনে ভাবলাম হয়তো সঠিক জায়গাতেই আমি আমার মেধা, শ্রম আর সময় বিনিয়োগ করেছিলাম। তাই হয়তো আজ আমার এই খারাপ সময়ে আমি সেই বিনিয়োগের ফল পেলাম। এমন অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এখন আমার জন্য সম্পদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার কিছুটা খারাপ লাগাও কাজ করলো এই ভেবে যে আজ আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিও একটি খারাপ সময় পার করছে। এ অবস্থায় সরকার যদি শিক্ষক হয়, আর নাগরিকবৃন্দ যদি ছাত্র হয় তাহলে ছাত্র-তো শিক্ষকের কথা মানছে না, কিংবা শিক্ষক মশাই-ও কি সঠিক ভূমিকা পালন করছে?কেন টসে জিতে পুলিশকে বেটিং-ই করতে হবে? বোলিং করলেও তো হতো? কেন আইন কানুন মানাতে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামতে হবে? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সক্রেটিস তো চাইলেই পালিয়ে যেতে পারতো! তাহলে তিনি সরকারের আদেশ মেনে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে আমাদের কী শিক্ষা দিয়ে গেলেন? রাজনীতির ছাত্ররা ডেভিড স্টোনের নাম হয়তো শুনে থাকবেন। এই ভদ্রলোক তার “মূল্যের কতৃত্ব সম্পন্ন বরাদ্দ” তত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন “আইন যাদের জন্য তৈরি করা হয় তারাই যদি আইন না মানে তাহলে ঐ আইনের কোন মূল্য নেই। তাই প্রয়োজনে সরকার বল প্রয়োগ করে হলেও সেটা মানাতে জনগণকে বাধ্য করতে পারে”। বর্তমান দৃশ্যপটে মনে হচ্ছে ইস্টন সাহেবের কথাই দেশে দেশে কার্যকর। তবে রাজনীতি বা অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমাদেরকে এর বিকল্প-ও ভাবতে হবে। বল প্রয়োগের এই নীতি সাময়িক সমাধান হলেও সেটা দীর্ঘ মেয়াদী তেমন কোন সমাধান আনতে পারবে বলে আমার মনে হয় না। তাহলে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানটা আসবে কি করে? চলুন বাস্তবতার কষ্টি পাথরে একটু পরখ করে দেখি।

যে ইতালি আজ মৃত্যুপুরী তার উদাহরণ দিয়েই বুঝতে চেষ্টা করি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ টি দেশের অন্যতম একটি দেশ ইতালি। বিশ্ব ব্যাংকের ঘবি ঈড়ঁহঃৎু ঈষধংংরভরপধঃরড়হ নু ওহপড়সব খবাবষ জবঢ়ড়ৎঃ-২০১৯ এর ভিত্তিতে ৪২,২০৪ মার্কিন ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে দেশটি উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে রয়েছে। জাতিসংঘের খউঈ, উবাবষড়ঢ়রহম এবং উবাবষড়ঢ়বফ দেশের তালিকায় ইতালি উন্নত বিশ্বের একটি দেশ যেটি মানব উন্নয়ন সূচকে ২৯ তম অবস্থানে রয়েছে। দেশটির মোট জিডিপি (পিপিপি’র ভিত্তিতে) ২.৪৪৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বিশ্বের ১২ তম শীর্ষ জিডিপির অন্তর্ভূক্ত। দারিদ্র্যের হার মাত্র ৩.৫০%। কেবল ২০১৯ সালেই ইতালি সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যয় নির্ধারণ করেছিল ২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে খুব একটা না থাকলেও সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে ইতালি বিশ্বের ৮ম দেশ। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ইতালি বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে দেশের মোট জিডিপির ১২% এর-ও বেশি এ খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। অর্থাৎ সামরিক, অর্থনৈতিক সহ প্রায় অনেক দিক থেকেই ইতালি তার অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পেরেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো করোনা মোকাবেলায় কেন দেশটি হিমশিম খাচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে আরও কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। ২০১৫ সালে বিল গেটস তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, “আধুনিক বিশ্বে মানুষ যতটা না মিসাইলের আঘাতে মারা যাবে, তার চেয়েও বেশি মারা যাবে অজানা কোন জীবাণুর আক্রমণে। কেননা উন্নত দেশগুলো মিসাইল ধ্বংসের প্রযুক্তির উপর যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার তুলনায় সামাজিক ও মানবিক খাতে তাদের বিনিয়োগ অনেক অপ্রতুল।“ এবার আসুন ইতালির অবস্থাটা একটু আমরা মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করি। এতো উন্নত একটি দেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়ন খাতে মোট জিডিপির মাত্র ৮% ব্যায় করে থাকে। প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে এককভাবে এই বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ৩-৪% শতাংশ। গতবছর ইতালির পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে (চেম্বার অফ ডেপুটিজ) ২০২০ অর্থ বছরের বাজেট অনুমোদন হবার পর তৎকালীন ইতালির শিক্ষা মন্ত্রী খড়ৎবহুড় ঋরড়ৎধসড়হঃর শিক্ষা খাতে অপ্রতুল অর্থ বরাদ্দের অভিযোগ তুলে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। শতকরা ৯৮% শিক্ষার হার হওয়া সত্ত্বেও ইতালি বিশ্বের শীর্ষ আত্মহত্যার দেশগুলোর মধ্যে একটি যেখানে প্রতিবছর ৯% মানুষ আত্মহত্যা করে। ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈবহঃৎধষ ইধহশ ্ ডড়ৎষফ ইধহশ থেকে ঝণ নিতে নিতে ইতালি এখন বিশ্বের শীর্ষ চতুর্থ ঋণগ্রহীতা দেশ হিসেবে বিবেচিত। ইতালি সরকারের ঋণের হার মোট জিডিপির ১৩৪%। পাঠক একটু চিন্তা করে দেখুন! অবকাঠামো, পর্যটন, শিল্প বাণিজ্য কোন খাতেই ইতালি সরকার ব্যয় নির্বাহে কার্পন্য করেনি। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে তারা তাদের এসব সেক্টরকে দাঁড় করিয়েছিল। কিন্তু ফলাফল কি হলো? যে জনগণের জন্য এতসব উন্নয়ন তাদের জীবন বাঁচাতে আজ দেশটি কত অসহায়!

এবার নজর দেয়া যাক বাংলাদেশের দিকে। ঊঝঈঅচ জবঢ়ড়ৎঃ-২০১৮ বলছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৩৬ টি দেশের মধ্যে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে অর্থ বরাদ্দে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। (অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ অবস্থা শুধু কম্বোডিয়ায় বিদ্যমান)। নেপাল, মালদ্বীপ, ভারত ও আফগানিস্তানে বাজেটের যথাক্রমে ১৬% , ১৫% , ১৪% ও ১৫% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ থাকলেও বাংলাদেশে তা ১০% এর ঘরে। বহু বছর ধরেই শিক্ষাবিদ ও গবেষকগণ জিডিপির ৬% ও বাজেটের ২০% শিক্ষা খাতে বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছে। এছাড়াও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ০.৯% এবং বাজেটের ৪.৯২% বরাদ্দ রয়েছে যেটি কেবল অপ্রতুল-ই নয় বরং রীতিমতো অবাক করার মতো। এই হিসেবে জনপ্রতি চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ মিলছে মাত্র ১৪২৭ টাকা! এখন এই অর্থে কীভাবে ডাক্টার-রা পিপিই পাবে? কীভাবে আপনি আমি উন্নত চিকিৎসা সেবা পাব? এর উপর দুর্নীতি তো সর্বময় বিরাজমান! অন্যদিকে, শিক্ষা ব্যবস্থার এই বেহাল দশায় কীভাবে এদেশের মানুষ প্রকৃত মানব সম্পদে পরিণত হবে? শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা আর সার্টিফিকেটের বাইরেও শিক্ষার আর-ও কিছু দিক থেকে যায়। মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় নাগরিকদেরকে শিক্ষিত করতে না পারলে কোন উন্নয়ন-ই টেকসই হবে না। সুতরাং বিনিয়োগটা বেশি হোক শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য। তাহলেই জনগণ হবে আদর্শ নাগরিক, আর তখনই তারা সংবিধানের ২১(১) অনুচ্ছেদের সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সম্পত্তি রক্ষার মতো নাগরিক কর্তব্য পালনের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি লাঠিপেটা ছাড়াই মেনে চলবে। এক-ই সাথে সরকারি কতৃপক্ষও সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদের সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করার মতো সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিটিও মেনে চলবে। অন্যথায়, সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ দিয়ে সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যাবে না।

তথ্য সূত্র: বিশ্ব ব্যাংক, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ব্যানবেইসের ই-৯, প্রথম আলো-১২জুন, ২০১৯ তথ্য সংশ্লিষ্ট রিপোর্ট

লেখা-নাজমুল হাসান
অ্যাসিস্ট্যান্ট নেভাল অফিসার, বাংলাদেশ নেভি, মিনিস্ট্রি অফ ডিফেন্স।

দেশদর্পণ/এফএফ/এসজে