সিন্ডিকেটে বন্দি টিসিবির পণ্য, ভোক্তাদের নাগালের বাইরে

করোনার প্রভাবে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারের টিসিবি পণ্য বিক্রিতেও ব্যাপক অনিয়মের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সিন্ডিকেটের কব্জায় পুরোপুরি বন্দি হয়ে পড়েছে টিসিবির পণ্য। এসব পণ্য চলে গেছে সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে। উপজেলার বিভিন্ন বাজারের মুদি দোকানে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ -টিসিবির পণ্য। খাবারের হোটেলেও এসব পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে তেল, ডাল, চিনি সবই বিক্রি হচ্ছে অন্যান্য পণ্যের মতো।

বিভিন্ন মুদির দোকান থেকে বর্তমান ‘করোনা বাজার’ মূল্যে ক্রেতারা কিনছেন টিসিবির পণ্য। খাবারের হোটেলে বিভিন্ন খাবার তৈরি হচ্ছে সরকারি এসব পণ্য দিয়ে। সরকার নির্ধারিত মূল্য, লাল ব্যানার, আর নির্ধারিত বিক্রেতা ছাড়াই অবৈধভাবে বিক্রি হচ্ছে এসব সরকারি মালামাল।

উপজেলার টিসিবি ডিলার গোলাম মোস্তফা ওরফে নাড়ু হাজি সাব-ডিলারদের সহযোগিতায় টিসিবির মাল হরিলুট করছেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার প্রায় প্রতিটি বাজারে এসব পণ্য অবৈধভাবে বিক্রি করে আসছে এই সিন্ডিকেট।

সরেজমিনে গিয়ে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। বেরিয়ে এসেছে টিসিবির মালামাল ক্রয়-বিক্রয় প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় ‘করোনা বাজার’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা বর্তমান বাজার মূল্যে বিভিন্ন দোকানে হরহামেশা এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ২১ মার্চ (শনিবার) উপজেলার হোসেনবাদ বাজারে গিয়ে টিসিবি ডিলার গোলাম মোস্তফা ওরফে নাড়ু হাজির প্রতিষ্ঠানে লাল ব্যানার দেখা যায়নি। পাওয়া গেছে নির্দিষ্ট খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য সরবরাহের তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার তারাগুনিয়া বাজারের সিনথিয়া টেডার্স নামে একটি দোকানে খুচরা বিক্রির জন্য আগের দিন (২০ মার্চ) টিসিবি পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে। সেখানে দেয়া হয়েছে, ৬৭ হাজার ৫শ টাকার মালামাল। এর মধ্যে রয়েছে, ১০ বস্তা চিনি, ২ বস্তা ডাল, ৪০ জার ৫ লিটার তেল ও ৯০ বোতল ২ লিটার তেল। ওই দোকানের মালিক শহিদুল ইসলাম প্রথমে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পরে এর সত্যতা স্বীকার করেন। বলেন, এই মালগুলো রাতে আনা হয়েছে। আগেও সেখান থেকে এসব মাল নেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া হোসেনাবাদ বাজারের রকমান হোটেলে ২০ বস্তা চিনি এবং একই বাজারের আরমান স্টোরে তেল ও চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। তথ্যসূত্র আরো জানায়, ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহের জন্য ওই এলাকার মইদুল ইসলাম ও রতনের বাড়িতে গোপনে টিসিবি পণ্য মজুদ রাখা হয়েছে। ব্যবসায়ী ছাড়া সাধারণ ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে না কোনো পণ্যই। ফলে নিন্মআয়ের সাধারণ ভোক্তারা সেখান থেকে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন।

একাধিক খুচরা ব্যবসায়ী স্বীকার করেন, ডিলার নাড়ু হাজির কাছে থেকে টিসিবির এসব পণ্য ক্রয় করা হয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় রশিদ দেয়া হয়নি তাদের। সাদা কাগজে মালামালের বিবরণ ও মূল্য বসিয়ে হিসেব ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে এ উপজেলার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার বেশামাল হয়ে পড়েছে। অনেকে এই বেশামাল পরিস্থিতিকে ‘করোনা বাজার’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রশাসনের নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাঝেই মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বেশি দামে নিত্যপণ্য বিক্রি করছেন।

বদলি অাদেশে কার্যত অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শারমিন আক্তার জানান, এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবগত আছেন। তিনিই বিষয়গুলো দেখছেন।

জানতে চাওয়া হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আজগর আলী বলেন, আমরাও এমন অভিযোগ শুনেছি। সত্যতা পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ ধরনের কাজে ডিলারশিপ বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি জানান, হঠাৎ দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার খবরে গত কয়েকদিন ধরে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় চার লক্ষাধিক টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

অভিযুক্ত টিসিবি ডিলার গোলাম মোস্তফা ওরফে নাড়ু হাজি নিজের বিরুদ্ধের অভিযোগ অস্বীকার করেননি। গণমাধ্যমের কাছে আংশিক স্বীকার করেন। তবে তিনি সাব-ডিলারদের ওপর সব দায় চাপানোর চেষ্টা করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, শুরু থেকেই এ উপজেলায় একইভাবে সিন্ডিকেট করে অবৈধ উপায়ে টিসিবির পণ্য বিক্রি হয়ে আসছে। মাঝখানে সাময়িক বন্ধ করে দেয়ার পর আবারো শুরু হয়েছে এই সিন্ডিকেটের তৎপরতা। উপজেলার সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের ফলে টিসিবির মাধ্যমে নিম্নআয়ের ভোক্তাদের কাছে সরকার নির্ধারিত ন্যায্যমূল্যে পণ্য পৌঁছে দেয়া ও বাজারে সামঞ্জস্যতা বজার রাখতে সরকারের নেয়া উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে।