সড়ক দূর্ঘটনা ও প্রতিকার

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন কোনো না কোনো তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে এবং এতে প্রতি বছর অসংখ্য মৃত্যুর পাশাপাশি হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে । এই সব দুর্ঘটনার ফলে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছে এবং যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবন যাপন করছে, একমাত্র তারাই এর কঠিন যন্ত্রণা এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারে। এই কঠিন বাস্তবতা আপনার আমার জীবনে যে কোন সময় ঘটতে পারে ।অতীতে আমরা বহু ইন্টেলেকচ্যুয়াল ব্যক্তিত্বদের হারিয়েছি। এখন প্রশ্ন হলো কেন এত দুর্ঘটনা? এর থেকে পরিত্রাণের কি কোনো পথ নেই? কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অথবা ফিটনেস না থাকার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

আমার পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি শুধুমাত্র চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং রোড সাইন না বুঝে যেখানে সেখানে ওভারটেক করার কারণে ঘটছে এসব মারাত্মক দুর্ঘটনা। মহাসড়কে চলাচলরত গাড়িগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত পিছনের গাড়ি সামনের গাড়িকে ওভারটেক করতে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা যেন শান্তি পায় না। এই মনোভাব পরিহার না করা পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটতে থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে । এসব কারণ সম্পর্কে আমরা প্রায় সকলেই অবগত আছি। তবে দুর্ঘটনার জন্য মূল ভূমিকা পালন করে চালক নিজে । ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে সেটাও আমি চালককে দায়ী করব । কারণ গাড়ি বের করার পূর্বে গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে সবকিছু চেক করার দায়িত্ব চালকের। বর্তমান বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে বাস চালকেরা ।একজন চালককে বুঝতে হবে তার ওপর নির্ভর করছে উক্ত গাড়ির সমস্ত যাত্রীর জীবন এবং তাদের পরিবারের জীবন । তার একটা ভুলের কারণে যেকোনো পরিবারে আসতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতি।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গাড়ির মালিক অনেকাংশে দায়ী কারণ অনেক মালিক গাড়ি মেরামত না করে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালাতে চালককে বাধ্য করে। একজন চালক একটানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চলনার কথা অথচ মালিকরা তাদের দিয়ে দিয়ে প্রায় ১৩/ ১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছে। বিশেষ করে সকালের দিকে যেসব দুর্ঘটনাগুলো ঘটে, সেটা ঘুমের কারণে ঘটে ।গাড়ি চালানো অত্যধিক পরিশ্রমের কাজ যেকোনো সময় ঘুম চলে আসতে পারে ।অনেক সময় মালিকেরা চালকদের দ্বারা অন্যায় দাবি পূরণ করতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে চালকরা বেশি উপার্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালায়। এই অন্যায় দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হলে অনেক সময় মালিকেরা চালকদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে নিম্নমানের চালকদের দিয়ে গাড়ি চালায়। ফলে দুর্ঘটনার হার বেড়ে যায়। তাই মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন যদি বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত এবং চালকদের চাকরির নিরাপত্তা দিতে পারতো তাহলে এইসব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো।

অনেক যাত্রী চালকদের দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করে । এটা পরিহার করতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ । তাই মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ গাড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও পুলিশের তৎপরতার কারণে অনেক এলাকার মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়ি গুলো বন্ধ আছে। যেহেতু মহাসড়কের সমস্যাগুলো স্বল্প সময়ে সমাধান করা সম্ভব নয় তাই আমাদের গাড়ির গতি কমাতে হবে । বাস এবং ট্রাক এর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটার এর উপরে হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। বেশির ভাগ দূর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কের বাঁকে। বাক এলাকায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাদা লম্বা দাগ দেওয়া থাকে। এই সমস্ত জায়গায় ওভারটেক করা নিষেধ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকদের রোড সাইন না বুঝে ওভারটেক করার চেষ্টা করে ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।

ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার পূর্বে চালকদের রোড সাইন, গাড়ির হেডলাইট এর সঠিক ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইন এর বেসিক বিষয়গুলোর উপর প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। পথচারীদের পথ চলার নিয়ম না জানার কারণে ঘটছে মারাত্মক দুর্ঘটনা। রাস্তা পার হওয়ার জন্য প্রথমে ডানে তাকাতে হবে তারপর বামে পরিশেষে ডানে তাকিয়ে রাস্তা পার হতে হবে। দুর্ঘটনা এড়াতে পথচারী হিসেবে সব সময় ডান পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে।  পথ চলার নিয়ম সম্পর্কে প্রাথমিক স্তরে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত থাকা জরুরি। বর্তমান অধিক সি সি যুক্ত বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে বহু প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে মা-বাবা সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব ।

প্রথমত মহাসড়কের এই দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারা দেশে স্পিড গানের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতি জেলায় যদি গাড়িসহ দুটি টিম নিয়োগ করা যায় এবং প্রতিটি টিমকে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারণ করে দিয়ে স্থান পরিবর্তন করে স্পিড গানের মাধ্যমে গাড়ির গতি শনাক্ত করে যদি দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে মামলার জরিমানা করা অব্যাহত থাকে তাহলে মহাসড়কে চালকরা দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে সাহস পাবে না । গাড়ির গতি সনাক্ত করার জন্য একজন পুলিশ সদস্য স্পিডগান এবং ধিষশরব-ঃধষশরব সহ কোন গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দ্রুতগতির গাড়িগুলো শনাক্ত করে নির্ধারিত ৫০০ মিটার দূরে অবস্থানরত টিমকে কত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে তা ওয়াকি টকির মাধ্যমে উক্ত টিমকে অবহিত করে যদি ওইসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং এই ক্ষেত্রে জরিমানা মালিকের পরিবর্তে চালককে বহন করতে হয় তাহলে পরবর্তীতে চালক দ্রুত গতিতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকবে । যদি প্রতিটি টিমে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা যায় এবং দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার মহোদয় নির্দেশনা মূলক পরামর্শ দেয় তাহলে উক্ত টিম কাজ করতে উৎসাহিত হবে ।

এছাড়া এ টিম মহাসড়কে নসিমন করিমন এবং ইজিবাইক সহ মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়ির বিরুদ্ধে জরিমানা করে মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। স্পিড গানের ব্যবহার যদি সারাদেশে মহাসড়কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থান পরিবর্তন করে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নগদ জরিমানা করা অব্যাহত থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস সারাদেশের মহাসড়ক ৭ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ আসতে বাধ্য এবং জাতি এই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে। আমার অভিমত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে যে নগদ জরিমানা করা হবে তার শতকরা ৫০ ভাগ টাকা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উক্ত টিমকে ইন্সেন্টিভ হিসেবে দেওয়া হলে এবং অবশিষ্ট ৫০ ভাগ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করলে উক্ত কাজ করতে তারা উৎসাহিত হবে। দ্বিতীয়ত মহাসড়কের এই দুর্ঘটনা কমাতে প্রতিটি গাড়িতে স্পিড গভর্নর সিলের ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাসের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার এবং ট্রাকের জন্য সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার নির্ধারণ করে গভর্নর সিল সংযুক্ত করা হলে চালক ইচ্ছা করলে নির্ধারিত গতির অধিক গতিতে গাড়ি চালাতে পারবে না। ফলে জাতি এই সড়ক দুর্ঘটনার অভিশপ্ত কবল থেকে রেহাই পাবে।

দেশদর্পণ/এসএমআর/এসজে