বিশৃঙ্খলার মাঝেই ফুলে ফুলে ভরে উঠলো শহীদ মিনার

মহান ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় বৃহস্পতিবার রাত ১১টা থেকে জড়ো হতে থাকেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিভিন্ন এলাকার কয়েকশ মানুষের গন্তব্য ছিল উপজেলা পরিষদ চত্ত্বরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। তবে বিপত্তি বাধে পুষ্পস্তবক অর্পণের সময়। উপজেলা প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় এই প্রথমবার সেখানে দেখা গেল চরম বিশৃঙ্খলা। একে একে পর্যায়ক্রমে ফুল দেয়ার কথা থাকলেও সে সময় প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে প্রশাসনের সামনে শহীদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান করেন বহু মানুষ। জুতা-সেন্ডেল পায়ে করেই অনেকে ফুল দিতে উঠে পড়েন শহীদ মিনারে। আর এমন বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যেই ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনারের বেদি।
শুক্রবার রাত ১২টা ১ মিনিটে একুশের প্রথম প্রহরে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ. ক. ম. সরোয়ার জাহান বাদশাহ শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিনি। সঙ্গে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. শরিফ উদ্দিন রিমন, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ ছাদিকুজ্জামান খান সুমনসহ দলীয় নেতৃবৃন্দ।
এরপর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. এজাজ আহমেদ মামুন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার, দৌলতপুর থানা পুলিশের পক্ষে অফিসার ইনচার্জ এসএম আরিফুর রহমান পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এ সময় তাদের সাথে ছিলেন উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও দৌলতপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তারা। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের তরফে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন ইউএনও শারমিন আক্তার।
এ ছাড়া জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহরিয়ার জামিল জুয়েলের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে যুবলীগ, দৌলতপুর প্রেসক্লাব সভাপতি অ্যাড. এমজি মাহমুদ মন্টুর নেতৃত্বে প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ, দৌলতপুর রিপোর্টার্স ক্লাবের সভাপতি মানজারুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে রিপোর্টার্স ক্লাব নেতৃবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
দৌলতপুর মডেল কলেজ, উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ওয়ালটন প্লাজাসহ বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। তবে স্থানীয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনার কারণে মধ্য রাতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা প্রায় সবাইকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এ সময় অনেকে উপজেলা প্রশাসনের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন। কেউ কেউ সেখান থেকে ফিরেও যান।
 যে কারণে বিশৃঙ্খলা : রাত ১২টা বাজতে মিনিট দশেক বাকি থাকতে সংসদ সদস্য অ্যাড. আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ, সাবেক সংসদ সদস্য রেজাউল হক চৌধুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শহীদ মিনারে আসেন। সংসদ সদস্য আসার আগেই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরাসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কয়েকশ মানুষ শহীদ মিনারের সামনে অবস্থান করছিলেন। একপর্যায়ে মাইকে ঘোষণা আসে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্যায়ক্রমিক তালিকা। সংসদ সদস্য শহীদ মিনারে ওঠার আগে ওসি এসএম আরিফুর রহমান সংবাদকর্মী ছাড়া অন্যদের সেখান থেকে নেমে আসার অনুরোধ জানান। ওসির অনুরোধ উপেক্ষা করে বেশ কয়েকজনকে ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
অপেক্ষার পালা শেষ হয় রাত ১২টা ১ মিনিটে। সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ দলীয় নেতাদের নিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে শহীদ মিনারের পাদদেশে ওঠেন। এ সময় আরো বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ওপরে উঠে পড়েন। তখন মোবাইলে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে সেলফি তুুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের ছবি তোলার কারণে সংবাদকর্মীরাই ছবি নিতে ঠিক মতো দাঁড়াতে পারেননি। হয়েছেন নাজেহাল। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনাকাঙ্ক্ষিত লোকজন শহীদ মিনারের ওপর ভিড় করে হইচই, ঠেলাঠেলি করতে থাকায় চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফুল দিতে হিমশিম খেতে হয় প্রায় সবাইকে। অন্যদিকে ফুল দিতে গিয়ে বীর শহীদদের প্রতি অবমাননার ঘটনাও ঘটে। কেউ কেউ জুতা-সেন্ডেল পায়ে করেই শহীদ মিনারের বেদিতে ওঠেন। ফুলও দেন। তাদের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে চিনতে পারা গেছে। তার জুতা পরা ছবিও সংরক্ষিত আছে।
শহীদ মিনারের ওপরে ভিড়ভাট্টা বেড়ে যাওয়ায় একপর্যায়ে সংসদ সদস্য সরওয়ার জাহান বাদশাহ সেখান থেকে নিচে নেমে আসেন। তখন অন্যরাও নেমে আসবেন মনে করে উপস্থিত সবার মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু তা হয়নি। এমপি নেমে আসলেও মোবাইলে ছবি তুলতে থাকা লোকগুলো ওপরেই থেকে যান। শহীদ মিনারের ওপরে অন্তত অাধাঘণ্টা ধরে চলে চরম বিশৃঙ্খলা। এ বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যেই পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণের মধ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। ফুলে ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনারের বেদি। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ফুল দেয়ার পর্ব শেষ না হতেই কেউ কেউ বেদি থেকে পুষ্পস্তবক নিয়ে চম্পট দেয়। এদিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিবসে প্রশাসনের এই উদাসীন কিংবা দায়সাড়া মনোভাবে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এর আগে কখনো এখানকার শহীদ মিনারে ফুল দেয়া নিয়ে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা যায়নি বলে উপস্থিত লোকজন জানান।
পরে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রেওয়াজ অনুসারে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় উপজেলা পরিষদ মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল জলিলের পরিচালনায় বিশেষ দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এই দোয়ার পর শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম প্রহরের কর্মসূচি সমাপ্তি ঘোষণা করা হলেও সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়নি। এ কারণে রাতে মানুষজন যখন বাড়ি ফিরছিলেন, সে সময় মানুষের মুখে মুখে প্রশাসনের সমালোচনা শোনা যায়।
এদিকে শুক্রবার অমর একুশের সকালের কর্মসূচিতেও অনিয়ম ও সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ে। শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর সময় রাতের মতোই বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে জুতা-সেন্ডেল পায়ে শহীদ মিনারের পাদদেশে উঠে ফুল দেয়ার হিড়িক চলে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সকাল সাড়ে ৮টায় সংসদ সদস্য আ. কা. ম. সরওয়ার জাহান বাদশাহ’র নেতৃত্বে যখন র‍্যালি বের করা হয় তখনো ইউএনও শারমিন আক্তার আসেননি। র‍্যালি শেষে সকাল ৯টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর ইওএনও ছোট পরিসরে আলাদা একটি র‍্যালি বের করেন। তড়িঘড়ি করে দায় এড়ানো ওই র‍্যালি শেষ করে আলোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন ইওএনও শারমিন আক্তার।
প্রত্যক্ষদর্শী এক সংবাদকর্মী জানান, সকাল ৯টা ১০ মিনিটে আলোচনা অনুষ্ঠানে গিয়ে ইউএনও সংসদ সদস্যের কাছে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার আমাদের র‍্যালি কখন।” এ সময় সাংসদ অনুষ্ঠানস্থল থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় স্বল্প পরিসরে আরেকটি র‍্যালি বের করা হয়। ওই র‍্যালিতে ফটোসেশন করে সাংসদ আলোচনা অনুষ্ঠানে ফিরে যান। পরে ইওএনও আশেপাশে ঘুরে স্বল্প সময়ে র‍্যালিটি শেষ করেন। শহীদ দিবসের কর্মসূচি পালনেও ইউএনও শারমিন আক্তার তালগোল পাকিয়ে ফেলায় নতুন করে সমালোচিত হচ্ছেন তিনি।
অন্যদিকে উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সারাদেশে জেলা, উপজেলা এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে স্কাউটস, রোভার স্কাউটস সদস্যরা শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভির্য ও সৌন্দর্য্য রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলেও দৌলতপুরে তাদের রাখা হয়নি।
শুধু এবারের এই শহীদ দিবসেই নয়, বর্তমান উপজেলা প্রশাসন অধিকাংশ জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার সঙ্গী হয়ে আছে। সব শেষ মুজিববর্ষের ক্ষণগণনার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এই প্রশাসনের অবহেলা চোখে পড়ে। বারবার প্রশাসন দায়সারা কর্মসূচি পালন করে সমালোচনার খোরাক যোগান দিচ্ছে। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও বের হচ্ছে। কিন্তু ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।