কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী

মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার কাগজ-কলমেই রয়ে গেছে। সাংবিধানিকভাবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলেও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো উপেক্ষিত মাতৃভাষা। ভাষা আন্দোলনের ৬৮ বছর পরও নিছক বাস্তবায়ন হয়নি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার। একুশে ফেব্রুয়ারির দিনটিকে ঘিরে আবেগ-উচ্ছ্বাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে চলছে বিদেশি শব্দের

আগ্রাসন। সংবিধান, আইন আর সরকারি নির্দেশনার পরও অবহেলিত বাংলা ভাষা। গাড়ির নম্বরফলক, বাড়ির নাম, বিপণি বিতান, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ও আদালতের রায় লেখায় চলছে ইংরেজির দাপট। সেই সঙ্গে বাংলা-ইংরেজির জগাখিচুড়ি শব্দের ছড়াছড়ি বাংলা ভাষাকে ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন উদাসীনতার জন্যই সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তবে সরকারপক্ষের দাবি, বাংলা একাডেমির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শিগগিরই সর্বস্তরে মাতৃভাষা প্রচলন করা হবে।

একাত্তরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।’ একাত্তরের ৩০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘোষণা দেন, বাংলা হবে দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ভাষা। বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এরই আলোকে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮৭ সালের মার্চে পাস হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। আইন অনুযায়ী দেশের সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজন ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহার করবে। নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে।

আইনে বলা হয়েছে, উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তবে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। দীর্ঘদিন ধরে অকার্যকর আইনটি কার্যকরের জন্য ২০১৪ সালে হাইকোর্টে একটি রিট করেন আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন। পাশাপাশি মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব ও সংস্কৃতি সচিবকে এ আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেন। এরপর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একাধিকবার প্রতিবেদন দাখিল করা হয় হাইকোর্টে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে ওই আদেশ বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। জানতে চাইলে রিটকারী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ ভোরের কাগজকে বলেন, আদালতের রায়ের কোনো বাস্তবায়ন হয়নি। পরে আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আদালত অবমাননার একটি মামলা করা হয়েছে। সেটির শুনানি হয়নি। আদেশ বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের অসহযোগিতা, বিদ্যমান দ্বিদলীয় রাজনীতি ও বাংলা ভাষার প্রতি জনগণের অবহেলাকে দায়ী করছেন তিনি।

এদিকে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ২০০০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো মহাসচিব কোইচিরো মাতসুয়ারা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের জন্য বিশ্বের ১৮৮ দেশের প্রতি আনুষ্ঠানিক আহ্বান জানান। এরপর থেকে সারাবিশ্বে নিজ নিজ ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গবেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও নিজ দেশে এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণ মর্যাদা পায়নি বাংলা ভাষা। আমাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় পাঁচ কোটির কাছাকাছি মানুষ বাংলা লিখতে পড়তে পারে না। যেটুকু চর্চা চলছে সেখানেও উপেক্ষিত বানানরীতি। বিপণি বিতান থেকে সাইনবোর্ড সবকিছুতে ইংরেজির দাপট, শিক্ষাঙ্গনে অস্তিত্ব হুমকির মুখে বাংলা, অশুদ্ধ ভাষায় বের হচ্ছে গল্প কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ বই। এ ব্যাপারে বরেণ্য শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, মাতৃভাষার জন্য বাঙালির ত্যাগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের পরও আমাদের কাছে, আমাদের প্রতিদিনের জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে। উপেক্ষিত হচ্ছে বাংলা ভাষার চর্চা।
আমরা প্রমিত ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের উন্নত ভাষাকেও বিসর্জন দিচ্ছি। অন্যদিকে বানান নিয়ে আমাদের দেশে একটা বিশৃঙ্খলা চলছে। কিন্তু আইন করে তো আর সঠিক শব্দ মানুষের ওপর চাপানো যাবে না। মানুষকেও সচেতন হতে হবে।

অন্যদিকে সরকারপক্ষ বলছে, প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে বাংলা। কম্পিউটারে লেখালেখি, বই-পুস্তক ও পত্রপত্রিকা প্রকাশ, গবেষণা, ওয়েবসাইট নির্মাণ, তথ্য ও ছবি অনুসন্ধান, ই-মেইল, গুগল, ফেসবুক, মোবাইলে এসএমএস বাংলাতেই করা যাচ্ছে। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের বর্তমান ভাষাভাষির মধ্যে সপ্তম বৃহৎ মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলেন ২৬ কোটি ৫০ লাখ ৪২ হাজার ৪৮০ মানুষ। এছাড়া নিজ ভাষাসহ বিশ্বের অন্যান্য মাতৃভাষা রক্ষা, লালন, বিকাশের অঙ্গীকার নিয়ে আশার আলো দেখাচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলা ভাষার উৎকর্ষতার জন্য রয়েছে বাংলা একাডেমি।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ভোরের কাগজকে বলেন, উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে কাজ চলছে। এছাড়া সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর জন্য বাংলা একাডেমির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ করা হবে।