যে স্কুলে নেই অবকাঠামো, আছে পদ দখলের লড়াই

কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের ধর্মদহ গ্রামে নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত ধর্মদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অবহেলিত এই স্কুলটিতে নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, আছে শুধু ক্ষমতাবানদের মধ্যে পদ দখলের লড়াই। মাটির রাস্তা, ছোট ছোট ঘর। এখনো শিক্ষার্থীরা বাঁশ বাগানের ভেতর দিয়ে চলাচল করে এই স্কুলে। একটি বেশ লম্বা আর আরেকটি ছবি আঁকা ঘরের মতো এক ঘর। দুটোই ঝাঁঝরা টিনের শেড। অল্প কিছু শিক্ষার্থী আর দৃশ্যমান ৫-৭ জন শিক্ষক দিয়ে কোনোমতে চলে এই বিদ্যালয়ের যাবতীয় শিক্ষাকার্যক্রম। যেখানে অযতœ, অবহেলা আর অনিয়মের আবরণে নিভু নিভু করছে জ্ঞানের আলোর মশাল।

সম্প্রতি বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের গণস্বাক্ষরিত একটি চিঠি পৌঁছে যায় কুষ্টিয়া জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও দৌলতপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। সেখানে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে প্রধান শিক্ষক রুস্তম আলীর নানা অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে। স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের নজরে আসে। বিপরীতে খুঁজে পাওয়া যায় খোদ প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নালিশী মামলার চিত্রও।

কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক, দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেণা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ আরো কয়েকজনকে বিবাদী করে দায়ের করা হয় ওই নালিশী মামলা। যার বাদী বিদ্যালয়টির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদপ্রার্থী ওবাইদুল হক। অন্যদিকে ঘটনা আরো জমে ওঠে আরেক নথির সূত্রে। যেখানে বর্তমান প্রধান শিক্ষক রুস্তম আলীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়ার সরকারি আদেশ রয়েছে। যদিও পরবর্তীতে পুনরায় বহাল কিংবা প্রধান শিক্ষক হিসেবে বৈধতার নথি দেখাতে ব্যর্থ হন অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক রুস্তম আলী।
আরও পড়ুন: ‘ভাড়াটে শিক্ষক’ দিয়ে চলছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

বেশ কিছুদিন সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা হয় বিদ্যালয়টির সার্বিক কার্যক্রমের ওপর। কথা বলা হয় বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সাথে। অভিযোগের তীর রুস্তম আলীর দিকে রেখে বিভিন্ন দিনে বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী জানাতে থাকেন বিদ্যালয়ের অযতœ, অবহেলা আর পদ দখলের লড়াইয়ের কথা।

সূত্র মতে, প্রধান শিক্ষক রুস্তম আলী স্কুলকে দেয়া বরাদ্দের টয়লেট নির্মাণেও স্পষ্ট দুর্নীতি করেছেন। অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বিদ্যালয়ের প্রায় সব অবকাঠামো উন্নয়নে। দেখা যায়, ১৫ বছর আগের দেড় লাখ টাকা বরাদ্দের স্কুলঘরের বেহাল দশা। যদিও বিশেষ বরাদ্দের ওই ঘরটিতে দেয়া টিনগুলো আলাদা অনুদান থেকে নেয়া। বর্তমান সরকার আমলে দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অজপাড়াগাঁয়ের স্কুলগুলোতেও উঠছে বড় বড় বিল্ডিং। অথচ প্রতিষ্ঠার এতদিনেও এই স্কুলটিতে লাগেনি কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া।

হঠাৎ হঠাৎ এসে হাজিরা খাতায় নিজের স্বাক্ষর করা। অধিকাংশ সময় অনুপস্থিত থাকা। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়মিত জাতীয় সঙ্গীত, শপথ বাক্য পাঠের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষক রুস্তম আলীর সুনির্দিষ্ট অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট দাপ্তরিক কাগজপত্র অফিসে না রেখে নিজের আওতায় রাখার বিষয়ে ওঠা শিক্ষকদের অভিযোগের যথাযথ উত্তর মেলেনি রুস্তম আলীর কাছে থেকে।

এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক রুস্তম আলী দাবি করেন, এগুলো সব চক্রান্তের অংশ। কিন্তু চক্রান্ত কেন? এমন প্রশ্নে বেরিয়ে আসে আরো ভেতরের খবর। তথ্য পাওয়া যায়, স্কুলটির ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে শিক্ষক রুস্তম আলীর সমর্থিত সভাপতি প্রার্থী প্রশাসন বিরোধী মামলার বাদী ওবাইদুল হক। সম্প্রতি কমিটি নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় প্রশাসন নির্বাচন কার্যক্রম স্থগিত করেন। বিষয়টি সুরাহার জন্য প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সভাপতি প্রার্থী ওবায়দুল হক এবং শিক্ষক রুস্তম আলী যশোরের সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের প্রিজাইডিং অফিসারকে বাদ রেখেই কাগজপত্র করিয়ে নেয়ার দৌড়ঝাঁপ করেন।
আরও পড়ুন: খালেদার প্যারোল নিয়ে কাদেরের সঙ্গে কথা হয়নি: ফখরুল

এদিকে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনে অনিয়মের দায়ে রুস্তম আলীকে অভিযুক্ত করে স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বন্ধের নির্দেশও দিয়েছে স্থানীয় শিক্ষা অফিস।

সার্বিক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগের জবাবে যৌক্তিক তেমন কিছু দাঁড় করাতে পারেননি অভিযুক্ত শিক্ষক রুস্তম আলী। তবে সভাপতি প্রার্থী ওবায়দুল হক জানিয়েছেন, তার সভাপতিত্ব নিশ্চিত করতে তিনি দাপ্তরিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাবেন।

এলাকার আরেক সভাপতি প্রার্থী পাশের একটি স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস হোসেন ও একাধিক সাবেক সভাপতি এবং স্থানীয় বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের সাথে কথা বললে তারাও এসব প্রসঙ্গের সাথে সহমত পোষণ করেন। তবে শিক্ষক রুস্তম আলী এবং সভাপতি প্রার্থী ওবায়দুল হক প্রশাসন, স্থানীয় এমপি কাউকেই খুব একটা তোয়াক্কা করেন না বলে জানিয়ে তারা জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সবাই মামলা হামলার ভয় পান।

রুস্তম আলী এবং ওবায়দুল হকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিড়ম্বনায় এ উপজেলার ধর্মদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়টির সুব্যবস্থাপনা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অর্থনৈতিক সুবিধা আর পদ-পদবির ক্ষমতার লোভের কাছে বঞ্চনার শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। একই সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়ে নাজেহাল হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

দেশদর্পণ/এসআরএস /এসজে