পুলিশের কঠোর নজরদারী: ছিনতাইকারীদের দৈরাত্মা কমছেনা রাজশাহীতে

ছিনতাই রোধে পুলিশের কঠোর নজরদারী তারপরও কমছেনা ছিনতাইকারীদের দৈরাত্মা রাজশাহীতে। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টার রাবি শিক্ষক দম্পতি রিক্সায় চড়ে বাড়ি ফিরছিলেন পথে নগরীর বোয়ালিয়া থানাধিন তালাইমারী বাদুড় তলা এলাকায় মোটরসাইকেল আরোহী দুই যুবক শিক্ষক পত্নীর হাত থেকে ভ্যানিটি ব্যগ ছিনিয়ে গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যায়। খোয়া যায় ব্যাগে থাকা ৮ হাজার টাকা, দামি মোবাইল ও মূল্যবান কাগজপত্র।

ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে গত ১৯ জানুয়ারি রাত দুইটার দিকে রামেকের দুই শিক্ষার্থী আহত হন। এসময় তাদের নিকট থেকে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। এর দুদিন আগে গোদাগাড়ীর এক অটোরিকশা চালককে নগরীর সাগরপাড়া এলাকায় ছুরিকাঘাত করা হয়। অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে ওই অটো চালক যুবককে ছুরিকাঘাত করা হয়। শহরের এই ছিনাতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

রাজশাহী মহানগরীর এক এসআই অনেকটা আক্ষেপ করেই বলছিলেন, ‘এমন কোন দিন নাই যে ছিনতাই হচ্ছে না। আর ছিনতাই হলেই আমাদের ওপর চাপ বাড়ে। কিন্তু কোনোভাবেই ছিনতাই রোধ করা যাচ্ছে না। সড়ক ও মহাসড়কে ছিনতাই করছে এক শ্রেণির অটোরিকশা চালক ও মোটরসাইকেল আরোহী যুবকরা। চলন্ত অবস্থায় তারা ছিনাতাই করে অটো ও বাইকের গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ফলে শহরের ছিনতাইকারীরা অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর এতে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন নগরবাসী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ৬ আগস্ট ভোরে ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে রাজশাহী সিটি কলেজছাত্র ফারদিন ইসনা আশারিয়া রাব্বীকে (১৯) হত্যা করা হয়। রাজশাহীতে গত ৫-৬ বছরে ছিনতাইরকারীর ছুরিকাঘাতে অন্তত ৫টি হত্যাকান্ডে ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু পথচারী হত্যার ঘটনাটি প্রথম ঘটে গত ৬ আগস্ট। এর আগের হত্যাকান্ড গুলো ছিলো অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে। সম্প্রতি তালাইমারী থেকে কাজলা পর্যন্ত ঘটে যাওয়া একের পর এক ছিনতাই নিয়ে চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন নগরবাসী।

রাজশাহীর একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখন ছিনতাইকারীরা নানা কৌশলে ছিনতাইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছে। ভোরে বা গভীর রাতে পায়ে হেঁটে, দিনের বেলা কেউ মোটরসাইকেল নিয়ে আবার কেউ অটোরিকশা নিয়ে ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ছে। এরা অনেকটাই বেপরোয়া। বড় কোনো ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটার পর উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা আমাদের মোটরসাইকেল ও অটোরিকশা তল্লাশির জন্য ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করেন। কিন্তু যেখানে হাজার হাজার অটোরিকশায় ভরে আছে শহর, সেখানে কয়টা তল্লাশি করা যায়। এগুলোর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না আনলে ছিনতাই রোধ করা সম্ভব না। আবার মোটরসাইকেলে ছিনতাইকারী বাহিনীর সদস্যরাও বেপরোয়া।

এদিকে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সনাক) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহম্মেদ শফিউদ্দিন বলেন, ‘রাজশাহী নগরীর ছিনতাই এখন খুব বড় বেদনাদায়ক। গত ছয় মাসে যেভাবে একের পর এক ছিনতাই হচ্ছে, তাতে শান্তির শহর রাজশাহীর নামই হয়তো এক সময় পরিবর্তন হয়ে গিয়ে ছিনতাইয়ের শহরে পরিণত হবে। কিন্তু এটি মেনে নেওয়া যায় না। এই ছিনতাইকারীদেও দ্রুতই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। প্রশাসন এবং আমাদের নগর সংস্থা ও রাজনীতিবিদরা একটু দৃষ্টি দিলেই শহরের ছিনতাই রোধ করা সম্ভব।

তিনি বলেন, ‘শহরের প্রতিটি মোড়ে মোড়ে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো দরকার। শহরে কারা অটোরিকশা চালায়, তাদের বায়োডাটাসহ অটোরিকশার সামনে ঝুলিয়ে দিতে হবে। যেন একজন যাত্রী সহজেই সেই চালকের নাম-পরিচয় মনে রাখতে পারে। আর মোটরসাইকেলযোগে ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে প্রশাসনকে। কোনোভাবেই কিশোরদের মোটরসাইকেল চালাতে দেওয়া যাবে না শহরে। কারণ বেশিরভাগ ছিনতাইকারী এই কিশোররাই। তাহলেই রোধ হবে এই ছিনতাই।’

শহরে ছিনতাই নিয়ে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘ছিনতাই কিছু কিছু ঘটছে। তবে এর জন্য আমাদের সকলের সচেতন হওয়া দরকার। ছিনতাই রোধে শুধু পুলিশ নয়, পথচারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে। এই ধরনের কোনোকিছু ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের জানাতে হবে। প্রয়োজনে ছিনতাইকারীদের ছবি তোলার চেষ্টা করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, ‘ছিনতাই রোধে আমরা পুলিশ সদস্যদের নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করেছি। এটি এখন আরো জোরদার করা হয়েছে। তবে শহরের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো দ্রুত সংস্কার করা দরকার। যেসব স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা নাই। সেসব স্থানে বসানো দরকার। তাহলে দ্রুত ছিনতাইকারী সনাক্ত করা যাবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়াও যাবে। তাহলেই নিয়ন্ত্রণে আসবে ছিনতাই।

এদিকে, রাজশাহীতে ছিনতাই প্রতিরোধে আলাদা ইউনিট গঠন প্রয়োজন বলে মনে করছেন রাসিক চিফ ইঞ্জিনিয়র মোঃ আশরাফুল হক।
তিনি বলেন, ছিনতাই নিয়ে শহরবাসী অনেকটাই উদ্বিগ্ন। শহরের নানা উন্নয়ন হচ্ছে। তার পরেও ছিনাতাই ভাবিয়ে তুলেছে আমাদের। এটি রোধ করা জরুরী হয়ে পড়েছে। এর জন্য সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে সবার আগে। সামাজিক সচেতনতা ছাড়া ছিনতাই রোধ করতে বেগ পেতে হবে। শহরে ছিনতাইয়ের অন্যতম কারণ মাদক নিণয়ন্ত্রণ না হওয়া।

দেখা গেছে এই মাদকসেবীরাই মূলত ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। তাদের যেকোনো মূল্যে মাদকের পথ থেকে সরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য শহরে উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটাতে হবে। শহরে বেকারত্ব দূর করতে হবে। এর জন্য বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শহরের বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে। এই বেকারত্ব দূর করণে নানামূখী কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।

শহরের ছিনতাইয়ের আরেকটা কারণ হলো অন্ধকার পথ। সড়কের যেসব স্থানে লাইট নাই একটু অন্ধকার, সেসব স্থানে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ছিনতাইকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে।

ছিনতাই রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ছিনতাই প্রতিরোধে আলাদা টহলব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে কমিউিনিটি পুলিশকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আলাদা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। যারা শুধু ছিনতাইরোধেই কাজ করবে। তাহলে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে শহরের ছিনতাই। এছাড়া শুধু উন্নয়ন দিয়ে ছিনতাই রোধ করা সম্ভব নয়।