বিজয়ের মাসে রাজাকারের তালিকা নির্মাণে নির্মম রসিকতা!!

যে কোন কারণেই, যে কোনো ভাবেই, যেকোনো পরিস্থিতিতেই রাজাকারের এই তালিকা প্রকাশ করা হউক না কেনো, তালিকায় এতো বড় রকমের নাম বিভ্রাট ঘটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হতে এই ধরণের ভুল সরকারের ভাবমূর্তির উপর যেমন প্রভাব পড়বে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ দলের হাতে ‘ইস্যু’ তুলে দেবার সহায়কও বটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে এমনিতেই তরুণদের আমরা সেভাবে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়েছি ‘৭৫ পরবর্তী সময়কালে নানা ইতিহাস বিকৃতির রাজনীতির মাঝে বড় হবার কারণে। আর যখন মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার ও জানাবার সময় এসেছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যখন সরকারে, তখনও ইতিহাস তৈরির তালিকায় এতবড় ভুল তরুণদের দ্বিধান্বিত করবে নিশ্চিতভাবেই। এমনিতেই জাতি হিসেবে দ্বিধান্বিত আমরা, সারাক্ষন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তি নানাভাবে তারুণ্যের শক্তিকে, আবেগ ও চেতনাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেবার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস, রাজাকারের নামের তালিকা নিয়ে এই ধরণের হালকা কাজ করা মূলত পুরো জাতির সাথে এক রকমের নির্মম রসিকতা করা হলো। এই রসিকতার ফল যাদের ঘরে যাবে, তারা বেশ লাভবান হলো, ক্ষতিগ্রস্ত হলাম আমরা, সামনের বাংলাদেশ ও তারুণ্য। এই ধরণের কাজের ফলাফল তো আমরা কিছুদিন আগেই দেখলাম! একটি পত্রিকা রাজাকারের নামের আগে শহীদ লিখতে কার্পণ্য করেনি! বাহ্!!!

ব্যাপক হারে নয়, যদি একটিও ভুল থাকে তার জন্য তালিকা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন। এই ধরণের তালিকা প্রকাশের আগে সকল ধরণের ক্রস চেক ও গভীর মনোযোগ প্রদান জরুরি ছিল। এটা কোনো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য না, যে দেয়া হলো, মানুষ ভুলে গেলো! এটাকে বলে ‘হিস্টোরিক্যাল ডকুমেন্টেশন’ বা ‘ঐতিহাসিক দলিল’, যেখানে ‘ওরাল হিস্ট্রি’ বা ‘মৌখিক ইতিহাস’ এর উপর ভিত্তি করে ‘রিটেন হিস্ট্রি’ বা ‘লিখিত ইতিহাস’ তৈরী হবে!!! এই মৌখিক ইতিহাস জানতে এলাকায় এলাকায় যেতে হবে, মানুষের মুখের ইতিহাস তুলে আনতে হবে। ঢাকায় এসি রুমে বসে কেবল পাক বাহিনীর ‘আর্কাইভাল ট্রাঙ্ক’ হতে ‘সেকেন্ডারী সোর্স’ বের করে এই তালিকা তৈরী করলে ইতিহাস বিকৃতি থেকেই যাবে, বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। এই এতো বড় কাজটি এইভাবে এতটা হেলায় ফেলায় হালকা করে করার কোনো সুযোগ নেই।

মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বাঙালির সবচেয়ে অহংবোধের জায়গা দখল করে আছে, তেমনি আবার রাজাকারের এই তালিকা বাঙালির সবচেয়ে ঘৃণার তালিকা। সেখানে কি করে এতো বড় সব ভুল হতে পারে? যিনি দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, তার জায়গা হতে, তার পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষ হয়ে ভাবুন, কতটা বেদনার, কতটা অমানবিক বিষয় এটা। একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকার এর তালিকায় স্থান দেয়া কতটা গর্হিত কাজ সেই বোধগম্যতাও আমাদের মাঝে তৈরী হয়নি, মনে হচ্ছে। আর এই ধরণের কাজের ফলাফল যে কতটা ভয়াবহ হবে, বোধ করি সেটাও আমরা বুঝতে পারছিনা। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব! তারুণ্যের অহংকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এই ধরণের নির্মম রসিকতা কোনভাবেই কাম্য নয়!

লেখক: রাশেদা রওনক খান, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।