শিশুর প্রথম শিক্ষালয় হচ্ছে বাড়ি

সন্তানদের সঠিকভাবে বড় করে তুলতে পারছি আমরা? জীবনযাপনের ধারণা পাল্টে যাওয়া, সন্তানদের প্রতি অহেতুক ভালোবাসা, বয়সের সঙ্গে বেমানান বিভিন্ন গেজেটের সহজলভ্যতা, নিজেদের ক্যারিয়ার বাঁচাতে মা-বাবার শিশুদের প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে এখন শিশুদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি কিছুটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শহরের ফ্ল্যাটকেন্দ্রিক জীবনে সন্তান পালনের বিষয়টি যে জটিল হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে একমত বিশেষজ্ঞরা।

বাংলায় ‘প্যারেন্টিং’বা ‘গুড প্যারেন্টহুড’শব্দের সঠিক প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। ‘অভিভাবক’শব্দটি প্রায়ই ‘প্যারেন্টস’বা ‘মা-বাবা’শব্দের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও মা-বাবা কোনোভাবেই শিশুর নিছক অভিভাবক নন—তার চেয়ে বেশি কিছু। কাজেই জীবনযাপনের ধারণায় যতই পরিবর্তন আসুক, যতই ব্যস্ততা বাড়ুক, শিশুদের বড় করে তোলার ক্ষেত্রে মা-বাবার বিকল্প নেই। কাজেই সবকিছুর পরেও মা-বাবাকে শিশু লালন–পালনের বিভিন্ন বিষয় শিখতে হবে বৈজ্ঞানিকভাবে। মনে রাখতে হবে, মা-বাবা বাড়িতে বা বাসায় যেভাবে শিশুকে ছোটবেলা থেকে বড় করে তুলবেন, ভবিষ্যতে শিশু সেভাবেই বড় হবে। কাজেই বাড়িটি হতে হবে শিশুর উপযোগী।

শিশুর স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় মা-বাবা কী করবেন

Related image

১. বিভিন্ন সূত্র থেকে শিশুবিকাশের বৈজ্ঞানিক কিন্তু সহজ সূত্রগুলো জেনে নিয়ে নিজের ও নিজ সন্তানের প্রবৃত্তিগুলো চিহ্নিত করে শিশু লালন–পালন শুরু করতে পারেন। সংস্কার বা কুসংস্কার ও অভ্যস্ততা থেকে যেসব অবৈজ্ঞানিক পূর্বধারণা লালন করেন, সেগুলোকে ধীরে ধীরে বাদ দিতে থাকুন জীবনযাপন থেকে।
২. শিশুকে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করা, শিশুর আত্মবিশ্বাসী হওয়া এবং মর্যাদাবোধ জাগানোর চ্যালেঞ্জ বোঝা এবং নিজে শিশুর মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এ কাজে সহায়তা করুন।
৩. স্বাধীন ও মুক্ত মানুষ হিসেবে শিশুর বেড়ে ওঠার পরিমণ্ডলের আয়োজন করুন।
৪. শিশুর প্রতিপালক বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানকারী না হয়ে নিজেরা শিশুর জন্য অনুকরণীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন।
৫. শিশুর সঙ্গে খেলা, গল্প বলা, রসিকতার সম্পর্ক তৈরির দক্ষতা অর্জন করুন।
৬. বিদ্যালয় ও বাড়ির বাইরের পরিবেশে অর্থাৎ শিশুর মেলামেশার সব ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করুন।
৭. পরিবারের বাইরে শিশুর চলাচলের সীমানা সুনির্দিষ্ট করা এবং তা বজায় রাখার চেষ্টা করুন।

শিশুকে কঠোর শাসনে রাখা এবং অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার মধ্যে সমন্বয় রাখুন। ছবি: অধুনাএর ফলে যে ব্যাপারে মা-বাবারা ভবিষ্যতে শিশুদের সহায়তা করতে পারবেন, সেগুলো হলো:

১. দুই বছর বয়সী শিশুর মনস্তত্ত্ব ও সাধারণ সমস্যা।
২. তিন বছর বয়সী শিশুর বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি অর্থাৎ স্কুল ও বন্ধু নির্বাচন করা এবং শিশুর মেলামেশার জন্য আরও বৃহত্তর পরিসরের ব্যবস্থা।
৩. শিশুর স্কুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা।
৪. শিশুর ছয় বছর বয়সের বাড়ির বাইরের চাহিদা পূরণ এবং সেই চাহিদা কম হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ।
৫. সাত বছর বয়স থেকে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির প্রতিটি ধাপের প্রতি সচেতনতা।

কোনো মা-বাবা ‘পজিটিভ প্যারেন্টিং’বিবেচনায় আনার আগ্রহ বোধ করলে নিজের বাড়িকে শিশুর প্রথম শিক্ষালয় ভাবতে শুরু করতে পারেন। বাড়িকে শিশুর শিক্ষালয় করে তুলতে মা-বাবা যা করতে পারেন।

• নিজেরা ভালো থাকার কথা ভাবুন। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে সব সময় আপডেট থাকুন।
• শিশুত্ব ও মাতৃত্ব-পিতৃত্বের মনোজাগতিক দিকগুলো জানার চেষ্টা করুন।
• নিজ নিজ শিশুর স্বকীয়তার স্বীকৃতি দিয়ে সে কীভাবে নিজে নিজেই শিখতে পারে, তা জেনে নিয়ে শিশুর জন্য শেখার অনুকূল পরিবেশ ও আবহ তৈরি করুন।
• মা-বাবা কিংবা বন্ধু না হয়ে সঙ্গী হয়ে শিশুর সঙ্গে গুণগত সময় কাটান।
• শিশুর আইকিউয়ের চেয়ে ইকিউয়ের (ইমোশনাল কোশেন্ট) ওপর গুরুত্ব আরোপ করুন।
• কথা, গণিত, সংগীত ও চিত্রকলা মানুষের এই চার প্রকার ভাষার সঙ্গে শিশুকে যুক্ত রাখুন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক হয়ে না শিখিয়ে বরং শিখতে সহযোগিতা করুন।

বাড়ি শিশুর প্রথম শিক্ষালয়, এ জন্য

• বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল বিনয়ী, সহজ ও ভয়হীন করে তুলুন, মা-বাবার ব্যক্তিত্ব যেখানে শিশুর জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠবে।
• পরিবারের কিছু নিয়মনীতি তৈরি করুন, যেগুলো বাড়ির সবাই শ্রদ্ধার সঙ্গে মেনে চলবে।
• নিজেদের মধ্যে অর্থাৎ গৃহস্থালির কাজে সাহায্যকারী মানুষটিসহ পরিবারের সবার মধ্যে সুসম্পর্ক থাকতে হবে।
• পরিবারে আনন্দময় পরিবেশ অব্যাহত রাখতে হবে।
• পারিবারিক সমস্যায় বা দুর্দিনে সবার অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা থাকবে।
• শিশুর সঙ্গে ‘অর্থহীন’ সময় কাটানোর জন্য অভিভাবকের রুটিনে সময় বরাদ্দ থাকবে। মাঝেমধ্যে সবাই মিলে আড্ডায় মেতে ওঠার চর্চা থাকতে পারে। রাতের খাবার সবাই মিলে খাওয়া পারিবারিক সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে।
• জীবনযাপনে উপভোগ থাকবে, কিন্তু ভোগবাদ থাকবে না। বাসায় বা বাড়িতে পরিমিত পরিমাণ জিনিসপত্র রাখুন। শিশুর মধ্যে অভাববোধ জাগ্রত রাখুন।

যেকোনো ধরনের সংকট বা দ্বিমতের ক্ষেত্রে মা-বাবা শিশুর সঙ্গে কথা বলবেন। কথা বলার জন্য যে অভ্যাস বা সংস্কৃতি বাড়িতে থাকবে:

• শিশুর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন—এতে শিশুটিও সব কথা শোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে।
• শিশু ভালো কিছু করলে বিস্তারিত ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যাসহ প্রশংসা করুন। তবে ভিত্তিহীন প্রশংসা করবেন না।
• শিশুর যেকোনো ইতিবাচক কাজের জন্য তার প্রশংসা করুন, সফলতার জন্য নয়।
• শিশুকে তার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে উৎসাহিত করুন।
• যুক্তির মাধ্যমে শিশুর চাহিদা না মেটানোর পারিবারিক সংস্কৃতি চালু রাখুন।
• মা-বাবার কথা বলার স্টাইল বা ধরনই শিশু অনুকরণ করবে। কাজেই মা-বাবাকে কথাবার্তায় মার্জিত, বিনয়ী হতে হবে।
• কোনো কিছু বলার আগে শিশুর অযৌক্তিক আচরণের পেছনের কারণ জানার চেষ্টা করুন।
• শিশুর কাছে অযৌক্তিক কিছু আশা করবেন না। বয়স অনুসারে অধিকার ও দায়বদ্ধতার একটি মানদণ্ড তৈরি করে তা বজায় রাখুন।
• শিশুকে দিয়ে কোনো কিছু করিয়ে নেওয়ার জন্য উপহার বা অন্য কোনো প্রলোভন দেখাবেন না কিংবা ভয় দেখাবেন না।
• শিশুর প্রত্যাশিত আচরণের দিকে মনোযোগ রেখে তার অপ্রত্যাশিত আচরণকে অবজ্ঞা করুন।

আরো পড়ুন :
সেঞ্চুরি করলেন নাসির, ৭ উইকেট নিয়েছেন রুবেল
সিগন্যাল অমান্য করায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত-১৫

কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে
• কী কী করা অনুচিত, তা না বলে কী কী করা উচিত, শিশুকে সেগুলো বলা।
• নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় মা-বাবা খেয়াল রাখবেন, যেন শিশুটি মনে করে আপনাদের মধ্যে অত্যন্ত জরুরি একটি আলোচনা চলছে। এটি অন্য সব কাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
• সঠিক কথাটি মনে না এলে মা-বাবার উচিত কথা থামিয়ে দেওয়া, কঠিন কিছু বলার চেয়ে কিছু না বলাই ভালো।

সরাসরি শিশুর অমঙ্গলের কারণ হতে পারে, সে রকম যে বিষয়গুলো করবেন না

• শিশুকে দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়ার জন্য শিশুর প্রতি মা-বাবার ভালোবাসার উল্লেখ করা যাবে না। সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা নিঃশর্ত বা আনকন্ডিশনাল। এই ভালোবাসায় শর্ত আরোপ করা হলে পারিবারিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্কে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হবে।
• মা-বাবার অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণের দায় শিশুর নয়। তাই আপনাদের অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝা শিশুর কাঁধে তুলবেন না।
• পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা এমনভাবে তৈরি করুন, যাতে সবাই মানতে পারে। তবে বড় শিশুদের ১৮ বছর বয়সের আইনানুগ আধিকারের কথা সাধ্যমতো বুঝিয়ে বলুন।

আরও দুটি বিষয় মনে রাখুন

• শিশুকে কঠোর শাসনে রাখা এবং অতিরিক্ত স্বাধীনতা দেওয়ার মধ্যে নিরন্তর সমন্বয় রাখা প্রয়োজন। কখনো এই সমন্বয় সম্ভব না হলে কঠোর শাসনের চেয়ে প্রশ্রয় ভালো পদ্ধতি।
• শিশু অকপটে ও নির্ভয়ে তার কথা বলতে পারে, পারিবারিক সম্পর্ক এবং আবহ সেভাবে তৈরি করুন। তার মানে এই নয় যে শিশুর কোনো নিজস্ব জগৎ থাকবে না। মা-বাবা শিশুর আশ্রয় ও সবচেয়ে কাছের মানুষ কিন্তু কোনোভাবেই বন্ধু নয়।

১২ নভেম্বর, ২০১৯  at ১০:২৩:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/প্রআ/এজে