ব্যাংকিং খাতই দুর্বল হচ্ছে নিয়মবহির্ভূত সুযোগ পেয়ে

বছরের পর বছর ধরে ১৪টি ব্যাংককে বাকিতে প্রভিশন রাখার সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। নিয়মবহিভর্‚ত এই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ব্যাংকগুলোও। এর ফলে ব্যাংকের কৃত্রিম মুনাফা বাড়ছে। এ মুনাফার ওপর সরকার সাড়ে ৩৭ শতাংশ ট্যাক্স নিয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বের হয়ে যাচ্ছে ডিভিডেন্ড আকারে ব্যাংকের অর্থ।

অন্যদিকে ব্যাংকের প্রকৃত মূলধনও সংরক্ষণ করতে হচ্ছে না। এতে ব্যাংকের ভিত্তি যেমন দুর্বল হয়ে পড়ছে, তেমনি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অন্ধকারে রয়েছেন সাধারণ গ্রাহক। ফলে আমানত রেখে ঝুঁকির মুখে পড়ছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গোপন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দেশের প্রথম প্রজন্মের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকগুলো পড়েছে বিপাকে। কেননা, এসব ব্যাংকের পুঞ্জীভ‚ত খেলাপি ঋণ বেশি। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখা হয় ব্যাংকের আয় থেকে। প্রভিশন সংরক্ষণ না করে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দেয়া যায় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি না রেখে লভ্যাংশ দেয়ার বিশেষ সুবিধা নিয়েছে ১৪ ব্যাংক। এক থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সময় নিয়ে ব্যালেন্সশিট সাদা করছে ব্যাংকগুলো। প্রত্যক্ষ কোনো আইন না থাকলেও বিশেষ বিবেচনায় এ সুবিধা দেয়ার কথা স্বীকারও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৮ সাল শেষে কেউ নগদ লভ্যাংশ, কেউ বোনাস লভ্যাংশ আবার কেউবা নগদ বোনাস উভয় লভ্যাংশই ঘোষণা করেছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী প্রভিশন ঘাটতি রেখে লভ্যাংশ দিতে পারবে না কোনো ব্যাংক।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকগুলোকে খেলাপি ঋণের ধরন অনুযায়ী প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ যত বাড়তে থাকে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণের হারও তত বাড়তে থাকে। মূলত, প্রভিশন ও সংরক্ষণ করা হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। প্রয়োজনীয় প্রভিশন ও সংরক্ষণ করতে না পারলে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি যেমন দেখা দেয়, তেমনি বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে মুনাফা স্ফীত হয় না।

মুনাফা কমে গেলে সরকারের ট্যাক্স দিতে হয় না। আর সাধারণের ডিভিডেন্ড দিতেও হিমশিম খেতে হয়। ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং (আর্থিক মানদণ্ড) খারাপ হওয়ার পাশাপাশি মার্কেট শেয়ারের মূল্যও কমে যায়। সাধারণ গ্রাহকরা এসব ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার আসল চিত্র জানতে পারলে ওই ব্যাংকে আমানত রাখতেন না। ফলে ব্যাংকের ব্যালেন্সশিট খারাপ হতো। এতে করে বৈদেশিক বাণিজ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ত। অর্থাৎ ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা জানলে সাধারণ গ্রাহক সচেতন হতে পারত। তারা এভাবে ঠকত না।

আরো পড়ুন:
পুরুষ সেজে ১৭ বছরের কিশোরীকে ধর্ষণ তরুণীর!
ঘূর্ণিঝড় বুলবুল: ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেন মিমি চক্রবর্তী

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র এবং নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম জানান, ব্যাংকগুলো থেকে এ বিষয়ে আবেদন জমা পড়েছিল। আবেদনের ভিত্তিতে বিশেষ বিবেচনায় এসব সুবিধা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তবে টাকা পরিশোধের জন্য তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়েছি আমরা। তুলনামূলক কম শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ এটি। তবে এর অপব্যবহারের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

তথ্য অনুযায়ী, ১৪ ব্যাংকের মোট সুবিধাপ্রাপ্ত টাকার পরিমাণ ১২ হাজার ৭৭১ কোটি টাকা। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে এবি ব্যাংক। আলোচ্য সময়ে এবি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই টাকা পরিশোধে ব্যাংকটিকে সময় দেয়া হয়েছে ১০ বছর। তবে ব্যাংকটিকে কোনো লভ্যাংশ প্রদানের অনুমতি দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুবিধা পাওয়ার দিক থেকে এবি ব্যাংকের পরের স্থানে রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।

প্রভিশন ঘাটতির ১ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা পরিশোধে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময় পেয়েছে ব্যাংকটি। ২০১৯ সালে ২০ শতাংশ, ২০২০ সালে ২০ শতাংশ, ২০২১ সালে ৩০ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ৩০ শতাংশ পরিশোধের শর্ত পূরণের ভিত্তিতে ২০১৮ সালে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করার অনুমতি পায় এনবিএল। এর পরেই রয়েছে সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড। আগামী ২০২০ সালের মধ্যে সব টাকা পরিশোধের শর্তে ১০ শতাংশ স্টক ডিভিডেন্ট দেয়ার অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৬০১ কোটি টাকা।

এ ছাড়া বাকি ব্যাংকগুলো হলো- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার এন্ড কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মার্কেনটাইল ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও আইএফআইসি ব্যাংক।

প্রসঙ্গত, নিয়ম অনুযায়ী আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ১৫টি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছিল। সাধারণ ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখার নিয়ম রয়েছে। আর যথাসময়ে আদায় না হওয়া নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত খেলাপি ঋণের বিপরীতে যথাক্রমে ২০, ৫০ ও ১০০ ভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে এ অর্থ রাখতে হয়। প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সাধারণভাবে লভ্যাংশ দেয়ার সুযোগ না থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ধাপে ধাপে প্রভিশন রাখার শর্তে কেউ কেউ লভ্যাংশ দেয়।

গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর সার্বিকভাবে ৫৭ হাজার ৪৩ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল। তবে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে ৫০ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দেখা যায়, ৬ হাজার ৬১৪ কেটি টাকা। ১৫টি ব্যাংক ঘাটতিতে থাকলেও বেশ কয়েকটি ব্যাংকে এক টাকাও প্রভিশন উদ্বৃত্ত নেই। এসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি প্রভিশন রাখতে পেরেছে। আর ঘাটতিতে থাকা ১৫ ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় ৯ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা কম রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার চার ব্যাংকের ঘাটতি সাত হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। বেসরকারি ১১ ব্যাংকে এক হাজার ৬৪০ কোটি টাকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, কয়েক বছর ধরেই কোনো এক অদৃশ্য কারণে প্রকৃত চিত্র আড়াল করার উদ্দেশ্যেই হোক, এসব ব্যাংককে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে না। তাদের বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এতে পরের বছরের নতুন করে ঘাটতির সঙ্গে পুরনো ঘাটতির টাকা সংরক্ষণের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ওই কর্মকর্তার মতে, এ ধরনের অনৈতিক সুযোগ আন্তর্জাতিক হিসাববিজ্ঞান নীতিমালার পরিপন্থী। এতে ব্যাংকের মূলধন লভ্যাংশ আকারে নানা উপায়ে বের হয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব ব্যাংককে বাকিতে প্রভিশন সংরক্ষণের সুযোগ দেয়া হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই পরের বছর প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারেনি। বরং বকেয়া প্রভিশনের সঙ্গে নতুন করে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এ ধরনের সুবিধা আর্থিক খাতের জন্য অশনি সংকেত। এতে ব্যাংকিং খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। আজ যাদের এ রকম সুবিধা দেয়া হয়েছে, তাদের দেখে আগামীতে অন্যরাও এই সুবিধা চাইবে। উৎসাহিত হবে ঋণখেলাপি। আড়ালেই থেকে যাবে ব্যাংকের আসল চিত্র। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও এক ধরনের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। এসব সমস্য সমাধানে ঋণ বিতরণের সময় গুণগত মান যাচাই-বাছাই করার পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের। আর্থিক খাতের রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

নভেম্বর ১১, ২০১৯ at ১১:০৩:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/ভোকা/এএএম