চৌগাছার কুখ্যাত রাজাকার ফরিদকে আড়াল করতে ছোট ভাই আ. লীগ নেতা সহিদুলের মিথ্যাচার

ভাই প্রমাণিত রাজাকার হলেও বাবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা সফল নেতা ছিল দাবি ছোট ভাই আওয়ামীলীগ নেতা সহিদুলের। যা উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে।

 

যশোরের চৌগাছা উপজেলার পাতিবিলা গ্রামের কুখ্যাত রাজাকার ফরিদ মিয়ার ছোট ভাই উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সহিদুল মিয়া তার বাবা মৃত আবুল হোসেন ওরফে শুকুর মিয়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা একজন সফল নেতা দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সকালে স্থানীয় রিপোর্টাস ক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলন করেন। সংবাদ সন্মেলনে সর্বোচ্চ মিথ্যাচার করেছেন ফরিদ রাজাকারের ভাই সহিদুল বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার জানিয়েছেন।

সংবাদ সন্মেলনে সহিদুল ইসলাম নিজের স্বাক্ষরিত এক বক্তব্যে তার পিতা মৃত আবুল হোসেন ওরফে শুকুর মিয়াকে ১৯৪৯ সালের পরে পাতিবিলা ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের (স্বাধীনতা পূর্ব) সাবেক সফল সহ-সভাপতি হিসেবে দাবী করেছেন। কিন্তু তৎসময়ের কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ নেতা রবিউল ইসলাম রাইটার এই নামে কাউকে চিনতে পারেননি।

তারপরেও কেনো এবং কি কারনে একজন ত্যাগী ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পথচলা সফল নেতার ( সহিদুল মিয়ার দাবী) বড় ছেলেই কুখ্যতি অস্ত্রধারী রাজাকার হয়ে দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন?? কারন অনুসন্ধানে নানা রকম চাঞ্চল্যকর তথ্য।

আরও পড়ুন:
রাজাকারের পক্ষে তদ্বীর করে বরখাস্ত হলেন ওসি
জেলা আ. লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি: কমিটির সদস্য তালিকায় মৃত ব্যাক্তির নাম!
আ. লীগের পদ পেতে মরিয়া কুখ্যাত রাজাকারের ভাই সহিদুল, ত্যাাগী নেতাদের ক্ষোভ

২২ অক্টোবর চৌগাছা উপজেলা রিপোর্টার্স ক্লাবে এক সংবাদ সন্মেলনে লিখিত বক্তব্যে উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সহিদুল ইসলাম মিয়া দাবী করেন যে তার পিতা মৃত আবুল হোসেন ওরফে শুকুর মিয়া ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিমলীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। পরবর্তীতে আবুল হোসেন ওই ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হন। এবং ১৯৬৮ সালে যশোর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সফল সহ-সভাপতি ছিলেন। যে কমিটির সভাপতি ছিলেন ফকির আহমেদ।

যিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এমপি হয়েছিলেন। সহিদুল মিয়া আরো দাবী করেন তিনি ১৯৭৮ সালে কালিগঞ্জ মহাতাব উদ্দিন ডিগ্রী কলেজের ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি আরো বলেন ১৯৯২ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক ছিলেন। এমনকি তিনি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ভ’মিকা রেখেছিলেন।

তাহলে কিভাবে এই সহিদুল মিয়ার বড় ভাই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারে যোগদান করেন? কিভাবে একজন আওয়ামীলীগের নেতার ছেলে হয়ে গ্রামের নিরীহ মানুষজনকে ধরে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন??

আরও পড়ুন:
বিয়ের প্রলোভনে কিশোরীকে গণধর্ষন, আটক ৩

অনুসন্ধানে এবং উপজেলা আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা বলে এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চৌগাছা উপজেলা কমান্ডে রক্ষিত দলিল অনুসন্ধানে জানা যায়,এই সহিদুল মিয়ার বড় ভাই ফরিদুল ইসলাম ওরফে ফরিদ উদ্দিন ওরফে ফরিদ মিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুখ্যাত অস্ত্রধারী রাজাকার ছিলেন। তার প্রমান ২০১১ সালের ২১ জানুয়ারি,বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চৌগাছা উপজেলা কমান্ডের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সিল ও স্বাক্ষর করা রাজাকার আলবদর ও আল শামস বাহিনীর নামীয় তালিকায় ১৫ নম্বরে লিখিতভাবে পাওয়া গেছে। স্ভাধীনতার পূর্বে এবং পরেও ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সহিদুল মিয়ার পরিবারের কেউ আওয়ামী রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না।

যার হাত ধরে আওয়ামীলীগে যোগদান করেন সহিদুল মিয়া সেই নেতা উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাষ্টার শাহাজাহান কবির। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী চৌগাছা থানার ( সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য ঘোষিত) প্রথম সভাপতি মরহুম মহাসিন মিয়ার ভাই। তিনি বলেন বলেন,সহিদুল মিয়া কখনোই যুবলীগ বা ছাত্রলীগ করেনি। তার বাবাও কোনো দিন আওয়ামীলীগের রাজনীতি করেছে বলেতো শুনিনি। তারা মুসলিগ পরিবার। সহিদুল জাসদের গনবাহিনীর সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।

একই কথা বলেছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন সহিদুলের বাবা কখনোই আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না বা জড়িতও ছিলেন না। তিনি বলেন সহিদুল মিয়ার বাবা বা সহিদুল কেউই আওয়ামীলীগের রাজনীতি করতেন না। সহিদুল মিয়া ১৯৯৪ সালে এসে আওয়ামীলীগে যোগ দেন।

উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক,জগদিশপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মাষ্টার সিরাজুল ইসলাম হাসতে হাসতে বলেন,লিখিত বক্তব্যে সহিদুল মিয়া প্রায় সবটাই মিথ্যা বলেছেন। তিনিও বলেন ১৯৯৪ সালের আগে সহিদুল মিয়া আওয়ামী রাজনীতির সাথে কোনো ভাবেই জড়িত ছিলেন না। তিনি বলেন সেসময়ে যুবলীগের কমিটি আমি নিজে থেকে গঠন করেছি। সে কমিটিতে কোনোভাবেই সহিদুল মিয়া ছিলো না। এবং তার বাড়ি ছিল ( কান্দি গ্রামে) আমার বাড়ির পাশেই। জগদিশপুর,পাতিবিলা ও হাকিমপুর নিয়েই সে সময় একটি ইউনিয়ন ছিলো।

১৯৯২ সালের ছাত্রলীগের সভাপতি পরবর্তীতে যুবলীগের সভাপতি চৌগাছা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন,তিনি যুবলীগ করলেন কবে? আর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেই বা তিনি কোথায় ছিলেন? তিনিতো ১৯৯৪ সালে আওয়ামীলীগে যোগ দিয়েছেন।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার ডাক্তার নুর হোসেন বলেন,সহিদুল পরিবারের কেউ আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। ৯৪ সালে এসে সহিদুল মিয়া আওয়ামীলীগে যোগ দেন। তার ভাই ফরিদ একজন অস্ত্রধারী কুখ্যাত রাজাকার এবং তারই আত্নীয় শাহাজাহান মিয়া ছিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং তার দুই ছেলে ফন্টু ও আলম ছিল রাজাকার।

উপজেলার শীর্ষ জনপ্রতিনিধিসহ আওয়ামীলীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতারাও বলেন,এ ব্যাপারতো উপজেলাব্যাপি সকলেরই জানার কথা। আওয়ামীলীগের যারা জানে না তারা কেনো জানে না সেটাই তো প্রশ্ন বললেন একজন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামীলীগের অঙ্গসহযোগী সংগঠনের সাবেক এক শীর্ষ নেতা।

সহিদুল মিয়া লিখিত বক্তব্যে লিখেছেন ২০০১ সালে বিএনপি জামাত জোট সরকারের আমলে বিভিন্ন মামলা ও হামলার শিকার হয়েছেন। উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা বলেন এটাও মিথ্যা বলেছেন সহিদুল মিয়া। ২০০১ সালে তিনি কালিগঞ্জে থাকাবস্থায় প্রতিদিন এসে মিছিল মিটিং করে আবার রাতের আধারে কালিগঞ্জ চলে যেতেন। তখন তিনি অনেক লোককে দেখতে পাননি যারা এখন উপজেলা কাইন্সিলকে সামনে রেখে মিথ্যা বানোয়াট সংবাদ দিয়ে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্ঠা করছে।

এঘটনায় রাগান্বিত হয়ে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বলেন তিনি কি মোটেও সত্যি বলতে জানেন না। লিখিত দিয়েও মিথ্যাকে সত্যি বলে চালানোর চেষ্টা করছে সহিদুল মিয়া।

পাতিবিলা ইউনিয়নরে একজন প্রবীন আওয়ামীলীগ কর্মী বলেন,“আমার নাম আব্দুল লতিফ। আমার বয়স ৭৫/৭৬ বছর। আমার জানা মতে সহিদুল মিয়াদের আদি বাড়ি ছিল কান্দি ( জগদিশপুর ইউনিয়ন)”। তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন,“আমি লাঠি হাতে করে আওয়ামীলীগ করা লোক।আর শুধু আমি কেনো চৌগাছার সকলেই জানে। আমার চোখের সামনে ৯৪ সালে আওয়ামীলীগে এসেছে সহিদুল মিয়া”।

জালাল উদ্দিন পুড়াহুদা গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন মেম্বর ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সদস্য বলেন,সহিদুল মিয়ার পরিবারের কেউই আওয়ামীলীগের লোক ছিল না। তবে খোকন মিয়া মোজাফফর ন্যাপ করতেন। শামসুল আলম আওয়ামীলীগের হয়ে ও সহিদুল মিয়ার চাচা ইদু মিয়া মুসলিমলীগ থেকে ইউনিয়ন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেছিলেন।(বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৩ বা ১৯৭৪ সালে সাংগঠনিক থানা হিসেবে চৌগাছা থানার প্রথম সভাপতি মহাসিন মিয়া ও শামসুল আলম সাধারন সম্পাদক ছিলেন )।

আরও পড়ুন:

তিনি প্রশ্ন করেন, সেসময় শুকুর মিয়া ওরফে আবুল হোসেন ও তার বড় ছেলে কি আওয়ামীলীগের প্রার্থী শামসুল মিয়ার নির্বাচন করেছিলো নাকি তার বিরুদ্ধে ইদু মিয়ার নির্বাচন করেছিলো ?? ইদু মিয়া কোন দল করতেন প্রশ্নের জবাবে রাগান্বিত হয়ে তিনি বলেন মুসলিমলীগ করতো।

শান্তি কমিটির সভাপতি শাজাহান মিয়ার ভাইপো ছিলেন ইদু মিয়া। সহিদুল মিয়ার ভাই ফরিদ মিয়া কি ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন,ফরিদ মিয়া ও তো রাজাকার। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় সহিদুল মিয়ার বড় ভাই ফরিদ রাজাকার,শাহাজাহান মিয়ার ছেলে ফন্টু ও আলমসহ বেশ কয়েকজন রাজাকার গ্রামের নিরীহ মানুষজনকে ধরে নিয়ে পাকসেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলো,ক্ষোভের সাথে জানালেন সাবেক ইউনিয়ন মেম্বর ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সদস্য জালাল উদ্দিন।

পাতিবিলা ইউনিয়নের সাবেক এক মেম্বর (১৫ বছর পাতিবিলা ইউনিয়নে ইউনিয়ন মেম্বর ছিলেন) দাবী করেন,সহিদুল মিয়া বা তার পরিবারের কেউই ১৯৯৪ সালের আগে আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিজের সক্রিয় ভ’মিকার কথাও লিখেছেন সহিদুল মিয়া। যা একবারেই মিথ্যা ।

চৌগাছা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা ও আ’লীগ নেতারা মনে করেন,কিছুদিন আগে রাজাকার ফরিদ উদ্দিন ওরফে ফরিদ মিয়া ওরফে ফরিদুল ইসলামকে নিয়ে স্থানীয় ও জাতিয় দৈনিক সংবাদপত্রে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদ মিথ্যা প্রমান করতেই আরো ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন সহিদুল মিয়া।

কিন্তু তিনি সংবাদ সন্মেলনে লিখিত বক্তব্যের কোথাও নিজের বড় ভাইসহ যেসকল রাজাকারদেরকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল তাদের সম্বন্ধে একটা কথাও বলেননি। তারা এও জানতে চেয়ছেন,“সংবাদ সন্মেলনে সহিদুল মিয়া আসলে কি প্রমান করতে চেয়েছেন?

অক্টোবর ২৩, ২০১৯ at ১৭:৫১:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/জিআর/তআ/ওআ