অপরাধ ত্রিভুজ থিওরি

সামাজিক অপরাধ ও ব্যক্তি অপরাধ, নৈতিক অবস্থান থেকে উপশম পাওয়ার একটি গবেষণামূলক থিওরি।

অনেকদিন আগে কাগজের উপর অঙ্কিত এই চিত্রটি একজন পেশাদার ছিনতাইকারী নিকট পাওয়া। এটি মূলত অপরাধ বিজ্ঞানের একটি কৌশল। একজন ছিনতাইকারী কি পরিমাণ দূধর্ষ হলে অপরাধের বৈজ্ঞানিক থিউরী তার জানা থাকে।

আমরা প্রতিনিয়ত অনেকেই ,অনেক বই পড়ি। কিন্তু অনেক সচেতন ব্যক্তি এই সম্পর্কে ধারনা রাখি না‌, কিন্তু অপরাধীরা রাখে।

আমরা সমাজের সচেতন মানুষ ।এই ধারণা গুলি জানা থাকলে অপরাধ সম্পর্কে অনেক সচেতন থাকা যায়। কিন্তু আমাদের সময় কোথায়। রেডিও-টেলিভিশন ইমেইল, ইন্টারনেট, ইমু ,ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদিতে ব্যস্ত থেকে সময় পার করি।

যাক নিজের স্টাডি থেকে অপরাধ সম্পর্কে কিছু জানা যাক। একটি অপরাধ সংঘটিত হতে হলে ন্যূনতম তিনটি উপাদান দরকার হয়। ১ পরিবেশ, ২ অপরাধী, ৩ অপরাধের শিকার অর্থাৎ ভিকটিম।

ভিকটিম:
সাধারণত নারী-শিশু ও দুর্বল চিত্তের ব্যক্তি ভিকটিম হতে পারেন। আবার যার নিকট টাকা আছে তিনি ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ভিকটিম হতে পারেন। যার ক্ষমতা আছে তিনি অন্য একটি ক্ষমতার ভিকটিম হতে পারেন। যার পদ আছে তিনি উর্ধ্বতন পদের দ্বারা ভিকটিম হতে পারেন। অনেক মূল্যবান জিনিস সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, তিনি চুরির ভিক্টিম হতে পারেন। শত্রুর দ্বারা ভিকটিম হতে পারেন। বন্ধু বা পরিচিত দের দ্বারা ভিকটিম হতে পারেন। পেশাদার অপরাধীর দ্বারা ভিকটিম হতে পারেন। সৌন্দর্য অথবা নিজের গুণ জ্ঞান ,নাম ,যশ ,খ্যাতি, অন্যের ঈর্ষার কারণ হলে ভিকটিম হতে পারেন। আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। সবগুলো থেকে সাবধানতা অবলম্বন করলে বা করার চেষ্টা থাকলে সে ক্ষেত্রে ভিকটিম হওয়ার সম্ভাবনা কম। ত্রিভুজের একটি বাহু হচ্ছে ভিকটিম। এক্ষেত্রে ভিকটিম নিজের সতর্কতায় বেঁচে গেলে অপরাধ সংঘটিত হবে না। এটা মোটামুটি সহজ কাজ। সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০% ভিক্টিমের কারণে অপরাধ হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন:
উলিপুরে ৪ মাতালসহ আটক ৬
স্বামীর নির্যাতনে গৃহবধূর আত্মহত্যা

অপরাধী:
সাধারণত কোন কিছু পাওয়ার আখাঙ্কা, লোভ লালসা, বিত্ত-বৈভব, নাম, যশ, সম্মান, উচ্চাসন পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে অপরাধ মন মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। অপরাধ মনের কুপ্রবৃত্তি, ভারসাম্যহীন চিন্তা, চেতনা, অবৈধ প্রাপ্তির ধ্যানধারণা, সমাজে, রাষ্ট্রে নিজেকে তুলে ধরা আর যোগ্যতাহীন চিন্তা-চেতনা থেকে মানুষ অপরাধ করে। কোন ব্যক্তির নিকট হতে ঠক, প্রতারিত হলে, অপমানিত হলে, প্রাপ্ত জিনিস না পেলে, অভাববোধ, শক্তির দাপটে শক্তিহীনতা, নিজে উচ্চাসন না পাওয়ার ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে অপরাধী হয়ে ওঠে।

অপরাধ করে বেঁচে যাওয়া, অপরাধের উপর জীবন ধারণ করা, অপরাধের মাধ্যমে বাহবা পাওয়া, অপরাধ চিন্তা লালন, ধারণ, বাস্তবায়ন করতে করতে অভ্যাসগত অপরাধী হয়ে ওঠে। সহজেই কোন কিছু প্রাপ্তির চাহিদা, সঙ্গদোষে , ভালো থাকার নেশায় অপরাধ করে। নিজের অযোগ্যতা বুঝতে না পেরে যোগ্যতমের কিছু পাওয়া দেখে নির্বুদ্ধিতার চিন্তার ফসল মানুষকে অপরাধী করে। স্বার্থসিদ্ধি, অবৈধভাবে চরিতার্থ করার অন্যের নজির দেখে, বা নিজের জন্য উপযুক্ত মনে করে, বা সহজ ,সময় সুযোগ, সুবিধা তার সহজলভ্যতা নিজেকে অপরাধে জড়িত করে। নৈতিক অবক্ষয় ,মস্তিষ্ক বিকৃতি, হতাশা, নষ্ট চিন্তা, ইত্যাদি সহ আরও কারণ থাকতে পারে।

নিজেকে এ সমস্ত চিন্তা থেকে বিরত রাখতে পারলে একজন ব্যক্তির অপরাধী হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। এক্ষেত্রে পরিবার, সমাজ, ধর্ম বা তার বন্ধুবান্ধব তাকে সহযোগিতা করলে অপরাধী হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু যুগে যুগে মানবসমাজে অপরাধী থাকবেই। ফিলোসফিক্যাল নেচার। তবুও নিজেকে অপরাধী হতে না দেওয়া একটু সহজ। তাতে করে অপরাধ ত্রিভুজের পরিপূর্ণ ছেদ ঘটানো যায়। জরিপে দেখা গেছে অপরাধী না হলে অপরাধ সিস্টেমকে ৩০% বন্ধ রাখা যায়।

পরিবেশ:
এটি অপরাধের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। কারণ ভিকটিম জন্মগ্রহণ থেকে বেড়ে ওঠা পরিবেশের মধ্যেই তা উঠে। অপরাধী ঠিক পরিবার, সমাজ, পরিবেশের মধ্যেই ঘুরপাক খায়।

ধরা যাক অপরাধী ধর্ষণ করবে, তাহলে তার সুনির্দিষ্ট একটি জায়গা যেমন নির্জন স্থান বা বদ্ধ ঘর, ভিকটিমকে একা পাওয়া, যখন লোক চলাচল কম, বিশেষ করে রাত্রিবেলা, বা ভিকটিমের ছবি মোবাইলে ব্লাকমেইলিং করা, বা সেখানে চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও কেউ জানতে না পারা, বা ছিনতাই করতে গেলে নির্জন রাস্তায় রাত্রেবেলা, যেখানে পুলিশের টহল নেই, জনসমাগম কম, বা ভিকটিম একা চলাফেরা করবে, বা খুন করলেও কেউ দেখবে না, বা কাজ করার কথা বলে চা মিষ্টি খাওয়ার নাম করে ঘুষ গ্রহণের চিন্তা, ইত্যাদি অপরাধ স্থান, কাল, পাত্র সময় সুযোগ, কৌশল ব্যবহার করে অপরাধী ভিকটিমকে স্বীকার করতে পারে।

সামাজিক অবস্থান এমন ভীত যে অপরাধ করলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি মানানসই হবে, তা পরিবেশ থেকে বিরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া আসবেনা, বা পরিবেশ পরিস্থিতি, চিত্ত বৃত্ত, দর্শন, অক্ষ, সমঝোতা, বিচার সালিশ সমষ্টিগত কর্মকাণ্ড অপরাধীর জন্য সুবিধাজনক হবে। পরিবেশের অন্যান্য নিয়ামক পরিস্থিতি অপরাধীকে ভিকটিম শিকারে সহজবোধ্য, নির্বিঘ্ন, করে দেয়।

এমন কোন পরিবেশ, পরিস্থিতি, আচার-আচরণ রীতিনীতি, আইন প্রথা, ও অন্য বিধ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া অপরাধীকে সহজবোধ্য ও পক্ষান্তরে স্বাভাবিক জীবনে বাধা না দিয়ে সহজ করে তোলে।

যে পরিবেশ পরিস্থিতি ব্যক্তি, গোষ্ঠী ,পরিবার সমাজ, ধর্ম, রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান, অর্থনীতি সমাজনীতি, জীবনধারণ প্রক্রিয়া, জন্ম ,বেড়ে ওঠা, ইত্যাদিকে নিষ্ক্রিয় করে তোলে সেই পরিবেশ পরিস্থিতি অপরাধী ও ভিকটিমকে সংযোগ করে একটি অপরাধ ত্রিভুজ তৈরি করে ফেলে।

ভিকটিম হওয়া থেকে বিরত রাখা, অথবা অপরাধী হওয়া থেকে বিরত থাকা একটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত চেষ্টায় হয়। কিন্তু সমস্ত ব্যক্তি গোষ্ঠী সবাই মিলে পরিবেশটাকে সমুন্নত রাখলে ত্রিভুজের ভূমির মতো অপরাধ প্রক্রিয়াটাকে প্রায় শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। এই পরিবেশ টাকে অপরাধ তৈরিতে ৫০% দায়ী করা যায়।

অপরাধের তিনটি উপাদান কে যদি যেকোনো প্রচেষ্টায় সংযোগ না ঘটায় বা বিচ্ছিন্ন রাখা যায় বা একটি উপাদানকে যদি অনুপস্থিত রাখা যায় তাহলে অপরাধ সংঘটিত হবে না।

এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত, সহজ ও প্রাথমিক অপরাধের ধারণা। এই ধারণাটি কে ব্যবহার করে সমাজে অপরাধ কমানো যায়। প্রাথমিকভাবে অপরাধ থেকে নিজেকে এবং সমাজকে মুক্ত করতে অপরাধ বিজ্ঞানের থিওরি বাস্তবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

ইমাউল হক, পিপিএমলেখক: ইমাউল হক, পিপিএম
পুলিশ পরির্দশক