বুয়েটে পড়েও কিছু শিক্ষার্থী অমানুষ, পাষন্ড ও কুলাঙ্গার হতে পারে

মা, আপনার ছেলে দেশের সেরা সন্তানই হয়েছে, জীবনের বদলে জানিয়ে দিয়ে গেছে, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতির নামে আসলে কি হচ্ছে!

সারাটা দিন খারাপ কেটেছে, অনেক কিছুই করতে চেয়েছি, কিন্তু মন পড়ে আছে আবরার ফাহাদের আঘাতের চিহ্ন সম্বলিত ছবিটায়। ফাহাদের বাবার ছবিটা দেখে থমকে যাচ্ছি বার বার, মায়ের কান্নাজড়িত চেহারাটা বার বার ভেসে আসছে ক্ষণে ক্ষণে।

আমি কেবল আবরার ফাহাদের মায়ের চেহারাটা বার বার দেখছি, কেবল ছবি নয়, কল্পনা করছি মায়ের মুখখানা, তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত! একজন শিক্ষক মা! এই সময়ে একজন সন্তানকে বুয়েটে ভর্তি করতে একজন মায়ের কি অবদান তা আমি কল্পনা করতে পারি কারণ সামান্য একটা ভালো স্কুলে ভর্তি করতে মায়েদের যুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি সন্তানের এস.এস.সি কিংবা এইচ.এস.সি পরীক্ষার সময় পরীক্ষার হলের সামনে অপেক্ষারত মায়েদের ঘর্মাক্ত মুখ খানা, চোখে ভাসে যেন। কর্মজীবী মায়েদের জন্য এই যুদ্ধটা আরও অনেক বেশি জটিল। কিছু মা’কে দেখেছি, ভোর ৫ টায় উঠে রান্না করে সন্তানকে ৭ টায় নিয়ে বের হয়, এক কোচিং হতে আরেক কোচিং, স্কুল, ইত্যাদি শেষ করে আবার রাতে সংসার সামলানো, সন্তানের হোম ওয়ার্ক সেরে কিছুক্ষনের ঘুম সেরে আবার সকাল হতেই দৌড়!

আমার নিজের শিক্ষক মা’কেও দেখেছি, তিন সন্তানের জন্য কি অসম্ভব পরিশ্রম করতেন। এই ধরণের মায়েরা সন্তানের পেছনে তার শ্রম, মেধা, শক্তি সব বিলিয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করেন না! এই ধরণের মায়েদের জীবনে একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে, নিজের সন্তান এবং শ্রেণীকক্ষের সন্তানদের সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা, এটা ছাড়া আর কোনোকিছুই গুরুত্ব পায়না তাদের জীবনে, অন্যান্য অনেকের মতো শাড়ি, বাড়ি, গয়না, ব্যাংক-ব্যালেন্স, পার্লার, টিভি সিরিয়াল, শপিং, এসব তাদের কাছে নিতান্তই অতি তুচ্ছ! এই ধরণের মায়েরা জীবন বিলিয়ে দেন সুসন্তান গড়ে তোলার জন্য।

আবরারের মা
আবরারের মা

আমি যখন আবরারের মায়ের ছবিটা প্রথম দেখলাম, মনে হচ্ছিলো এই মা’কে যেন আমি চিনি সেই ছোটবেলা হতে। এই মায়েরা অসম্ভব পরিশ্রমী, মায়াবী, দুর্দান্ত শক্তির অধিকারী হয়, রাত-দিন এক করে তাঁরা সন্তানদের মানুষ করেন, গড়ে তুলেন দেশের সেরাদের তালিকায় স্থান পাওয়ার জন্য। সেই মা যেন আজ নিথর, নীরব, বাকহীন, তাঁর সমস্ত শক্তি, বোধ, চেতনা সব যেন থমকে গেছে কোথাও! এই মা’কে স্বান্তনা দেবার ভাষা এই জগতে কেউ জানে বলে মনে হয়না। এই মায়েরা এতটাই জ্ঞানী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন যে, তাদের কোনো কিছু দিয়েই কিছু বুঝানো যাবেনা। এই মা’কে কেবল বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই, কেবল বলতে চাই, আপনার ছেলে দেশের সেরা সন্তানই হয়েছে, দেশকে দেখিয়ে দিয়ে গেছে, একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর জ্ঞান ও দেশ প্রেম আসলে কেমন থাকা জরুরি। আমরা অধিকাংশই যা পারিনা, আপনার সন্তান তা করে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।

আমার গর্ব হচ্ছে এই ভেবে যে, এই অস্থিরতার যুগে, এই নমঃ নমঃ আর অনুগত হয়ে উঠার যুগেও আপনার ছেলে কেমন শির দাঁড় টান টান করে নিজের মত প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশে এখনো এমন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আছে, যারা রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত না থেকেও দেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে জানে। মা, আপনার প্রতি গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ যে, আপনি এক অসামান্য দেশ প্রেমিক ছেলের জন্ম দিয়েছিলেন। আপনার ছেলে আমাদের সবার চোখ খুলে দিয়েছে, আমাদের জানান দিয়েছে, বুয়েটে পড়েও কিছু শিক্ষার্থী অমানুষ, পাষান্ড ও কুলাঙ্গার হতে পারে, অন্ধ আনুগত্য তাদের পশুতে পরিণত করেছে, মানুষ করেনি। সত্যি বলছি মা, আপনার সন্তানের জন্য আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু একইসাথে গর্ব হচ্ছে।

 

ক্যাম্পাসে মৃত্যুর ঘটনা এই প্রথম নয়। আবরারের মৃত্যু আমাদের সাবিকুন নাহার সনি’র কথা, আরিফ রায়হান দ্বীপ এর মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ২০০২ সালে দিনে দুপুরে সনি মারা যায়। আজ ১৭ টা বছর পেরিয়ে গেলো, তবুও বিচার হয়নি। খুনিরা হয়তো পালিয়ে গেছে বিদেশ আর মার্সিডিজ চালাচ্ছেন আমেরিকা-ইউরোপের কোনো দেশে! হয়তোবা তাদের কেউ কেউ এখন খোলস পাল্টে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের ভেতর অনুপ্রবেশ করে দিব্যি ভালো আছে, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটিয়ে সামনে নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে! অথচ সন্তান হারানোর কষ্টে, দুঃখে, সনির মা-বাবা-ভাই-বোন দিন পার করছেন। সনি হত্যার বিচার চেয়েছে এই ১৭ বছরে ক্যাম্পাসে কারা কয় বার , জানাবেন কেউ? কেন বিচার হচ্ছেনা, আসামিরা কোথায় কে -কেউ কি বলতে পারেন? আরিফ রায়হান দ্বীপ এর প্রসঙ্গে আসি, বুয়েট ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। গণমাধ্যম মারফত জেনেছি, ২০১৩ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া প্রথম সারির কন্ঠস্বর। তিনি যে দল করেন, সেই দল ক্ষমতায়, তবুও নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে কুপিয়ে মারা হয়েছিলো ছেলেটিকে। আর কিছু নয়, কেবল মতের ভিন্নতা থাকায় নৃশংস ভাবে মৃত্যুবরন করতে হয়েছিলো তাকে, নাকি ভিন্ন কোন কারণ ছিল? কেউ কি জানাবেন, দ্বীপ হত্যার কি বিচার হয়েছে?

দুঃখ হচ্ছে যারা সনি, দ্বীপ, আবরার কে মেরে ফেললো, সেইসব কুলাঙ্গারদের অভিভাবকদের জন্য, যারা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিয়েই নাক ডেকে ঘুমান, খবর রাখেন না, তাদের কুসন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে কি করছে, কতটা নষ্টদের দখলে চলে গেছে, তাদের জন্য করুনা হচ্ছে। … আমি নিশ্চিত, তারা আজ থেকে সমাজে মুখ লুকিয়ে চলবেন, খুনির মা-বাবা হিসেবে সবাই তাদের চিনবে। ধিক্কার জানাই সেইসব কুলাঙ্গারদের যারা ছাত্র নামের কলঙ্ক, মানবিকতাবোধহীন, ক্ষমতালিপ্সু, দালাল হয়ে উঠেছিলো।

মা, আপনাকে সালাম! আর আপনাকে কেবল বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নয়, পুরো জাতি সালাম জানাচ্ছে। আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুখটি আপনার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে, আমাদের আপনাকে দেবার কিছু নেই, কেবল আজ শুধু এইটুকু বলি, মা আপনি এমন এক সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যার জন্য আমরা সবাই গর্ব করছি, সাহস পাচ্ছি, উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করছি। বিশ্বাস না হলে আপনি বুয়েটের ক্যাম্পাসের দিকে তাকান মা, দেখুন আপনার সুসন্তানের জন্য বুয়েট কিভাবে কাঁদছে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটা বিপ্লবী হয়ে উঠেছে, কিভাবে উপাচার্যকে অবরোধ করে রেখেছে, তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে, তাঁকে ক্যাম্পাসে আসতে বাধ্য করছে। সারাদিন ধরে দেখছি, বুয়েটে শিক্ষার্থীরা কিভাবে যুদ্ধ করছে প্রশাসনের এর বিরুদ্ধে ..মা, আপনি এক সন্তান হারিয়েছেন, কিন্তু হাজারো সন্তান আপনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আবরার হত্যার বিচার চেয়ে মিছিল মিটিং করছে… ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য লড়াই করছে। লজ্জা হচ্ছে, ছাত্র নামধারী কিছু কুলাঙ্গারের জন্য যে ছাত্র রাজনীতি আমাদের অহংকার ছিল একসময়, সেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধে আজ সকল শিক্ষার্থী একত্রিত হয়েছে। আমরাও চাই, এইধরনের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, মাদক, টর্চার সেল, হল দখলদারিত্বের রাজনীতি বন্ধ হউক ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাস, হল এসবের উপর সকল শিক্ষার্থীর অধিকার সমান হউক।

 

মা, আপনার আবরার আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে কিভাবে মৃত্যুঞ্জয়ী হতে হয়, কিভাবে শির দাঁড়া টান টান করে চলতে হয়, কিভাবে সহপাঠীর মৃত্যুতে গর্জে উঠতে হয়, কিভাবে সত্য উচ্চারণ করতে হয়।আপনার প্রতি আজ কেবল কৃতজ্ঞতা জানাই, কোনো সহানুভূতি কিংবা সান্তনা নয়। মা, আপনার সন্তানের মতো সন্তান প্রতিটি ঘরে জন্মাক। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা রইলো।

লেখক: রাশেদা রওনক খান
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।