মুন্টু ডাক্তার একটি নাম নয়, ইতিহাস

ডাঃ মইন উদ্দিন আহমেদ (মুন্টু ডাক্তার) একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান। জেলাব্যাপী মূলত তিনি মুন্টু ডাঃ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। মু্ন্টু ডাক্তার সদা হাসোজ্জল, মায়াবী, বিনয়ী,অসম্ভব ভদ্র ও বহু গুনে গুনান্নীত একজন ব্যক্তির নাম। তিনি ছিলেন একাধারে জনপ্রতিনিধি, সমাজ সংস্কারক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একজন নিবেদিত জনসেবক।

মুন্টু ডাক্তার ১৯৩৬ সালের ১ নভেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাধীন শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের অন্তর্গত চৌধুরী পাড়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৃতঃ ডাঃ কলিম উদ্দিন আহমেদ ও মাতা মৃতঃ দেল আফরোজ। ১০ ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৯’ম।

পারিবারিকভাবে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হলেও তিনি মুলত ডাক্তারি পেশার মাধ্যমে নিজেকে মানব সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন। মানব সেবার মাধ্যমে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়ে আছেন আজও। ডাক্তার হিসেবে উনি এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, কথিত আছে কোন রোগীর চিকিৎসা করতে গেলে রোগী ডাক্তার সাহেবকে (মুন্টু ডাঃ) দেখেই অনেকটা সুস্থতা বোধ করতেন।

শিবগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি কখনও চিকিৎসা ফি চেয়ে নিতেননা। যে রোগী যে পরিমাণ টাকা দিতেন উনি তাই রেখে দিতেন কখনও গুনে দেখতেন না। আবার অনেক সময় কোন কোন রোগীর চিকিৎসা করার পর রোগীর অবস্থান বুঝে গিয়ে নিজেই টাকা বের করে দিতেন ওষুধ কিনে খাওয়ার জন্য।

মুন্টু ডাক্তার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিনোদপুর ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোহাঃ রুহুল আমিন বলেন, ডাঃ সাহেব চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন। ডাঃ সাহেব ছিলেন একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ আর এ সূত্রেই আমার গ্রামের এক গরীব পরিবারের মেয়ের বাচ্চা প্রসবের ঘটনায় সারারাত জেগে উনি চিকিৎসা করেন (১৯৮০ পরবর্তী সময়ে)।

পরের দিন সকাল বেলা বাচ্চা প্রসব হয়। ডাক্তার ফি তো দুরের কথা ওষুধ খাওয়ার পয়সা না থাকায় ডাক্তার সাহেব নিজে পকেট থেকে ৫০ টাকা বের করে দেন ঐ পরিবারটিকে অভাবগ্রস্থ, সমস্যা জর্জরিত মানুষের সমস্যা সমাধান করাই ছিলো উনার মূল উদ্দেশ্য। দলমত নির্বিশেষে উনাকে মানুষ ভালবাসতেন ও সমর্থন যোগাতেন শুধুমাত্র উনার সেবায় মুগ্ধ হয়ে।

আরো পড়ুন:
লাউড় রাজ্যের রাজধানীর পুরাকীতি ও প্রত্নতত্ত্বস্থলটি সরকারি তালিকাভুক্ত
ফারাক্কার গেট খুলে দেয়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত, পদ্মার পানি বিপদসীমার ওপরে

রোগী হিসেবে ডাক্তার সাহেবের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে উনি মাথায় হাত রেখে যখন জিজ্ঞেস করতেন যে তোর কি হয়েছে তখন মনে হতো আমার কিছুই হয়নি বলছিলেন দাদনচক পি,টি,আই-এর সাবেক ইন্সট্র্যাক্টর বীর মুক্তিযোদ্ধা জিল্লার রহমান।

তিনি বলেন, মুন্টু ডাঃ ছিলেন নেতাদের নেতা। ডাক্তার হিসেবে উনার মত ডাক্তার আমি আর একজনও দেখিনি। উনি অত্যান্ত ভদ্র একজন সামাজিক ব্যক্তি ছিলেন।

ইউপি নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে উনার নেতৃত্ব পর্যায়ে রাজনীতিতে প্রবেশ। ১৯৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র অসহোযোগ আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ডাঃ মন্টুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সুযোগ্য নেতৃত্ব চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রাজনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ।

মুন্টু ডাঃ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক শাহজাহান আলি মিঞা জানান, রাজনৈতিক মতপার্থক্যে থাকলেও আমাদের মধ্যে আন্তরিকতার কমতি ছিলনা কখনো। তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের সাথে উনার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি একজন মহান মানুষ ছিলেন। উনি দেশ ও জনগনের জন্য অনেক কিছুই করেছেন।

৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর সারাদেশে যখন আওয়ামিলীগ এর রাজনীতিতে দুর্দিন চলছিল সেই সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আওয়ামী রাজনীতির সকল নেতাকর্মীদের আগলে রাখার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করেছিলেন মুন্টু ডাক্তার।

নিজেকে মুন্টু ডাক্তারের শিষ্য বলে দাবি করা সরকার দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামিলীগ এর সিনিয়র সহ-সভাপতি মুহাঃ জিয়াউর রহমান বলেন, ডাঃ মুন্টু ছিলেন আমার নেতা, গণমানুষের নেতা। উনি মুক্তিযুদ্ধের একজন দক্ষ সংগঠক ছিলেন। রাজনীতিবীদ হিসেবে উনার যে প্রগতিশীল চিন্তা চেতনা ও দক্ষতা ছিলো তার জন্য মানুষ উনাকে চিরকাল স্মরনে রাখবেন।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঐতিহাসিক ভাষনের ধারাবাহিকতায় জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ ঘোষণা করেন বাঙালি জাতীর বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃতি সন্তান ডাঃ মইন উদ্দিন আহমেদ (মুন্টু ডাক্তার)।

মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে মুন্টু ডাঃ একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি যিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সাব-সেক্টরের খন্ডকালীন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন (বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দায়িত্ব নেবার পূর্ব পর্যন্ত)।

সিনিয়র সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা তোসলিম উদ্দিন বলেন, উনি একজন ভালো মনের মানুষ ছিলেন। উনার হাত ধরেই আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমার সাংবাদিকতা জীবনও উনার হাত ধরেই। উনি ছিলেন একজন সাংস্কৃতিক মনা মানুষ। নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি মানুষের সাথে কথা বলতেন।

ডাঃ মুন্টু ছিলেন শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারম্যান, প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৭০), স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গণপরিষদ সদস্য (১৯৭১-৭২)।তাছাড়া তিনি প্রথম ১৯৭৩ ও দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ডাঃ মইন উদ্দিন আহমেদ (মুন্টু ডাক্তার) ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। ১৯৭৩-৭৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

পরবর্তীতে তিনি জেলা আওয়ামিলীগ এর সভাপতি হিসেবেও অত্যান্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ডাঃ মুন্টু ১৯৭৯ সালে তৎকালীন বৃহত্তর রাজশাহী আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

বক্তা হিসেবে উনি এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, উনার বক্তব্য শোনার জন্য মানুষ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতেন।

জেলা আওয়ামিলীগ এর সহসভাপতি এ্যাডঃ মোঃ আবু নজর খান বৃটিশ বলেন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বিচক্ষণতার কারনেই মুন্টু ডাক্তারকে সাধারণ মানুষ খুব বেশি ভালবাসতেন।

উনি একজন সুবক্তা ছিলেন। বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে উনি অল্পতেই আকৃষ্ট করতে পারতেন তাছাড়া উনার বড় গুন ছিলো উনি খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারতেন।

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুন্টু ডাঃ এর বড় ভাই মোহাঃ আমিনুল হক ঘুটু বলেন, মুন্টু ছোট হলেও আমরা দুই ভাই বন্ধুর মতই মিশতাম। মুন্টু শৈশব থেকেই মানুষের সাথে খুব সহজেই মিশতে পারতো। বাবা-মায়ের প্রতি প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল ছিল সে। রাজনৈতিকভাবে তাকে একাধিকবার প্রানে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে প্রত্যেকবারই মুন্টু প্রাণে বেঁচে যায়।

ক্ষমা ছিল তার মহৎ গুণ। একবার বাররশিয়ার এক ব্যক্তি মুন্টুকে মেরে ফেলার জন্য গুলি চালালেও মুন্টুকে গুলি না লাগায় প্রাণে বেঁচে যায়। ঐ ঘটনায় এলাকাবাসী ঐ লোককে আইনে সোপর্দ করেছিল। পরে মুন্টুই ঐ লোককে জামিনে ছাড়িয়ে এনে আই, এ (এইচ এস সি) পরীক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করে এবং পরবর্তীতে তার চাকরিও করে দেয় মুন্টু।

মুন্টু ডাক্তার শিবগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শিবগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও রয়েছে উনার উল্লেখযোগ্য অবদান। মুন্টু ডাক্তারের উল্লেখযোগ্য কর্মযঞ্জের মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ রোড, শিবগঞ্জ-বিনোদপুর রোড, শিবগঞ্জ বেইলি ব্রীজ, আদিনা ফজলুল হক সরকারি কলেজকে সরকারিকরণ এবং শিবগঞ্জ সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়কে সরকারি করণ করেছিলেন।

তাছাড়া মনাকষা দাখিল মাদ্রসা, মনাকষা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিনোদপুর ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠায় রয়েছে উনার উল্লেখযোগ্য অবদান। শিবগঞ্জের মানুষের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, রণাঙ্গণের বীর সৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, জননেতা ডাঃমইন উদ্দিন আহমেদ (মুন্টু ডাক্তার) ২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর ৭৫ বছর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন।

অক্টোবর ০২, ২০১৯ at ১১:৩৬:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/জেডএইস/এএএম