চার দিন পর পুলিশের অভিযান এখন প্রশ্নবিদ্ধ

রাজধানীতে ক্যাসিনো ব্যবসার সূচনা হয় এক দশক আগে। নেপাল, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে আনা হয় খেলার জন্য ফিস শুটিং গেম মেশিন, রুলেট, জিকজার, চিপসসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। থানা পুলিশের যোগসাজশেই প্রথমে মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় গোড়াপত্তন হয় ক্যাসিনো কালচারের।

১১ নেপালি নাগরিকের সহায়তায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার হাত ধরে এর যাত্রা শুরু হলেও পরে মমিনুল হক সাঈদ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মোল্যা আবু কাউছারসহ অনেকে জড়িয়ে যান এতে। তবে সব কিছু হয়েছে পুলিশের জ্ঞাতসারে, নাকের ডগায়।

এমনকি কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এসব ক্লাবে মদ-বিয়ার মিলত অবাধে। যেন ক্যাসিনো ও জুয়ার অংশ হয়ে পড়েছিল মদ-বিয়ার। বিষয়টি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও জ্ঞাত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল ক্যাসিনো কালচারের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর। সে অনুযায়ী র‌্যাব বেশ কয়েকটি ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরে অভিযান চালালে সতর্ক হয়ে যায় অন্যরা।

ক্যাসিনো ও জুয়ার ক্লাব সংশ্লিষ্টদের নাম-পরিচয় জানা থাকলেও চুপ মেরে থাকে পুলিশ। র‌্যাবের অভিযানের তিন দিন পর চার দিনের মাথায় মুখরক্ষার অভিযানে নামে পুলিশ। তবে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসরের বাইরে ফিল্ম ক্লাব ও স্পা সেন্টারে অভিযান চালানোয় প্রশ্ন দেখা দেয়।

অনেকে মনে করেন, এতে মূল অভিযান হোঁচট খেয়েছে। তাদের অভিযোগ ক্যাসিনো সম্রাটদের আড়াল করতেই এলোমেলো অভিযানে নেমেছে পুলিশ।

ঢাকার অর্ধশতাধিক ক্যাসিনো ও জুয়ার ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এখনো রয়েছে অধরা। বিশেষ করে ‘ক্যাসিনো সম্রাট ’ যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট রমনা থানার পাশে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করলেও তাকে ধরতে পুলিশের অনাগ্রহে গোটা অভিযান নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

এমনকি ৬/৬ সেগুনবাগিচার ভাড়া বাসার ৬ তলা থেকে ক্যাসিনো সংশ্লিষ্ট ৬ নেপালি নাগরিকসহ রাজধানীর পৃথক দুটি ফ্ল্যাট থেকে মোট ১৯ বিদেশি নাগরিক সটকে পড়েছে পুলিশ প্রহরায়।

অভিযোগ উঠেছে, নিজেদের সংশ্লিষ্টতা আড়াল করার লক্ষ্যে ক্যাসিনো কালচার থেকে দৃষ্টি সরাতেই অনুমোদিত বার, স্পা সেন্টার ও ফিল্ম ক্লাবের মতো খুচরা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।

চলমান অভিযান প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল গতকাল সোমবার সচিবালয়ে বলেন, অপরাধীরা কে কোথায় আছে সেটি বড় কথা নয়; বড় কথা হলো কে কতটুকু অপরাধ করেছে। চুনোপুঁটি-রাঘববোয়াল বলতে কিছু বুঝি না। যারা অপরাধ করবে তাদেরই শাস্তি পেতে হবে।

অপরাধে জড়িত হওয়ায় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যকেও ছাড় দেয়া হয়নি। তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অবৈধ ব্যবসা ও টেন্ডারবাজির মতো অপকর্মের বিরুদ্ধে সরকারের এই অভিযান চলছে। যেখান থেকেই তথ্য আসছে সেই তথ্যের ভিত্তিতে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করছে।

গডফাদার বা গ্র্যান্ডফাদার বলতে আমরা কাউকে চিনি না। অপরাধ যে করবে তাকেই শাস্তি পেতে হবে। অপরাধীরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য বিমানবন্দরে রেড অ্যালার্ট জারি করবেন কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রেড অ্যালার্ট জারি করার কিছু নেই।

ইমিগ্রেশনে সবসময় অপরাধীদের একটি তালিকা থাকে, যেন তারা পালিয়ে যেতে না পারে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। অপরাধ করলে শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনী কিছুই জানে না, তাহলে এত বড় বড় ক্যাসিনো মেশিন এলো কীভাবে- এ ব্যাপারে আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, হতে পারে ছোট ছোট পার্স বা যন্ত্রাংশ বাংলাদেশে এনে সেগুলো অ্যাসেম্বল করা হয়েছে। তবে কীভাবে এগুলো এসেছে তাও দেখা হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চাঁদাবাজি, অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, চলবে। আমরা কাউকেই ছাড় দিচ্ছি না।

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, ক্যাসিনো সংশ্লিষ্টদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা ধরে অভিযান চলছে। যদিও পুলিশের অভিযানে এখনো কোনো ক্যাসিনো মালিক আটক হয়নি।

আরও পড়ুন:
এমপি নুসরাত ও মিমির নাচের ভিডিও ভাইরাল (ভিডিও)
অস্ত্রসহ আটক, কমিটিতে নেই তবুও যুবলীগ নেতা!

প্রসঙ্গত, গত বুধবার ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়া চক্র, বনানীর আহমেদ টাওয়ারের গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশে অভিযান চালায় র‌্যাব। পরদিন কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, এলিফ্যান্ট রোডে এজাক্স ক্লাব, কারওয়ান বাজারে প্রগতি সংসদে অভিযান চালায়। এসব অভিযানে আটক হয় ২০১ জন।

বুধবার গুলশানের বাসা থেকে যুবলীগ নেতা খালেদকে আটক করে র‌্যাব। কলাবাগানে গ্রেপ্তার করা হয় ক্লাব সভাপতি শফিকুল ইসলাম ফিরোজকে। এ ছাড়া টেন্ডারবাজির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় যুবলীগ নেতা জি কে শামীমকে। তারা রিমান্ডে আছেন। তবে পুলিশ মাঠে নামে চার দিন পর রবিবার দুপুরে।

মতিঝিলের আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাব, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে অভিযান চালায় পুলিশ। অন্য ক্লাবগুলোতে র‌্যাবের অভিযানের পর এসব ক্লাব তালাবদ্ধ ছিল। সে কারণে পুলিশের অভিযানে নাটের গুরু কেউ আটক হয়নি। ক্যাসিনোর বেশকিছু সামগ্রী জব্দ করেছে পুলিশ।

ক্যাসিনোর পালের গোদাদের পালানোর সুযোগ দিয়ে চার দিন পর চালানো পুলিশের অভিযান এখন প্রশ্নবিদ্ধ। একযোগে অভিযান না চালানোয় ক্যাসিনো ও জুয়ার ব্যবসা চালানোর সঙ্গে জড়িতরা সটকে পড়েছে নির্বিঘ্নে।

সরিয়ে ফেলেছে খেলার সরঞ্জাম, যা মামলার আলামত হিসেবে যুক্ত করা যেত। মতিঝিলের সোনালী অতীত ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া, আজাদ স্পোর্টিং ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, পল্টনের ঢাকা রেস্টুরেন্ট এবং রিক্রিয়েশন সেন্টারে ক্যাসিনো ও জুয়া হতো।

পল্টনের প্রীতম-জামান অমিত টাওয়ারের ষষ্ঠ তলায় ঢাকা রেস্টুরেন্ট ও রিক্রিয়েশন সেন্টার বন্ধ রয়েছে। বনানীর ‘এফ’ ব্লুকের ১ নম্বার রোডে অবস্থিত বনানী ক্লাব সচল রয়েছে। গুলশান ও উত্তরার একাধিক রিক্রিয়েশন ক্লাবও রয়েছে খোলা।

মতিঝিল ও ফকিরাপুল ক্লাবপাড়ার একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, থানার ওসি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই ক্লাবের টাকার ভাগ পেতেন। মাসোহারা যেত পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মহানগর পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেও। সবকটি ক্লাবে ছিল সার্বক্ষণিক সশস্ত্র আনসার প্রহরা। ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর ঘিরে থাকতো পুলিশি নিরাপত্তা।

কারা কীভাবে এসব পরিচালনা করতেন, কাদের আসা-যাওয়া ছিল ক্লাবপাড়ায় সবই পুলিশের মুখস্থ। এমনকি প্রতিটি ক্লাব পরিচালনা পর্ষদের তালিকাও ছিল মতিঝিল থানায়। প্রধানমন্ত্রীর হঠাৎ নির্দেশে বেকায়দায় পড়ে পুলিশ। এমনকি বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আয়ের বড় উৎসও।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, দেশে ১৫২টি অনুমোদিত বার রয়েছে। সম্প্রতি দেয়া হয়েছে আরো ২৫টির অনুমোদন। প্রক্রিয়াধীন রয়েছে আরো পায় ৫০টি। এসব বারের অনেকগুলোয় জুয়া চালু রয়েছে। যা থানা পুলিশ জানে। তবে এসব স্থানে অভিযানের ব্যাপারে অধিদপ্তর এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে জানা গেছে।

সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯ at ০০:৪৩:২৯ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/এএএম