সারাদেশের রেলপথের অধিকাংশের সংস্কারের অভাব

সারাদেশে মাত্র ৩ হাজার কিলোমিটার রেললাইন কিন্তু এইটুকুই সংস্কার বা পরিচর্যার অভাবে লাইনের নাটবল্টু, ক্লিপ, হুক খোলা, লাইনের নিচে মাটি নেই কিংবা নেই মাটি ধরে রাখার মতো পাথর। আর এ কারণেই ঘটছে দুর্ঘটনা। মারা যাচ্ছেন নিরীহ যাত্রী, অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছে। ক্ষতি হচ্ছে রেলের সম্পদ। রেলসূত্রে জানা গেছে, গত ৫ বছরে প্রায় হাজারখানেক ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। মারা গেছেন প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ, আহত সহস্রাধিক। আর এসব দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে রেল বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিয়মিত লাইন মেরামত ও পর্যবেক্ষণের অভাবেই রেল দুর্ঘটনা উপর্যুপরি ঘটেই চলেছে।

গত শুক্রবার কুলাউড়া স্টেশনে প্রবেশের আগে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং গত শনিবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়া স্টেশনের আউটারে কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে বেশ কিছু সময় সারা দেশের সঙ্গে সিলেটের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ থাকে। আহত হন অনেকেই। এর আগে গত ২৩ জুন রাতে সিলেটের মৌলভীবাজারের সিলেট থেকে ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেস কুলাউড়ায় দুর্ঘটনায় পড়লে ৪টি বগি লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর মধ্যে একটি বগি খালে পড়ে। এতে ৩ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় শতাধিক। এ দুর্ঘটনায় ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেসব রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মূলত লাইনের নাটবল্টু, ক্লিপ, হুক ফিশপ্লেট খোলা থাকায় এসব দুর্ঘটনা ঘটে। আর এ জন্য রেল পূর্বাঞ্চলের সিলেট বিভাগের রেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। কিন্তু তার পরেও থামেনি রেল দুর্ঘটনা। একই এলাকায় এক মাসের মধ্যে ৩-৪টি দুর্ঘটনা ঘটায় রেলযাত্রীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, গত জুন মাসে কুলাউড়ায় ট্রেন দুর্ঘটনায় ৩ জন মারা যান। অনেকেই আহত হন। সে সময় আমরা ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করি। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে আঞ্চলিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারসহ ২ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করি। আর একজনকে শাস্তিমূলক ট্রান্সফার করি। এ সময় লাইনের ত্রুটি সামনে আসে। সে কারণে আমরা সারাদেশে সব লাইন পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দেই। প্রধানমন্ত্রীও লাইন ও ব্রিজ মেরামতের ওপর জোর দেবার জন্য নির্দেশনা দেন। সে মোতাবেক আমরা কাজ করছি। তবে সম্প্রতি কেন পর পর ২ দিন একই এলাকায় দুটি ট্রেন লাইনচ্যুত হলো, তা আমি বুঝতে পারছি না। তবে অতিবৃষ্টির কারণে লাইনের কোনো ক্ষতি হয়ে এ দুর্ঘটনা কিনা তা জানতে হবে। প্রয়োজনে যাদের গাফিলতিতে হয়েছে তাদের শাস্তি দেয়া হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রী বলেন, বিগত বছরগুলোতে রেলের তেমন পরিচর্যা হয়নি। সে কারণে অনেক স্থানে লাইনের অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়ে আছে, যা মেরামত করার কাজ দ্রুত করা হবে, তবে কর্মী সংকটের কারণে তা কিছুটা সমস্যা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এদিকে প্রতি বছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন। কিন্তু সবকিছুই এক রকম নিষ্ফল করে দিচ্ছে জরাজীর্ণ রেললাইন। যেপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করে সেই রেলপথ দেখার যেন কেউ নেই। রেললাইন সংস্কার, মেরামত ও পরিদর্শনে এক রকম নির্বিকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

আরও পড়ুন :
রোহিঙ্গা সামলাতে বিপুল ব্যয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র‌্যালী

জানা গেছে, দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩২ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময়ই খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাটবল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন, অধিকাংশ স্থানেই তা নেই। কোনো কোনো স্থানে পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো। শুধু তাই নয়, সারা দেশে আছে ৩ হাজার ৬টি রেলসেতু। যার ৯০ শতাংশই তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে কোনোরকমে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন। সব মিলিয়ে এক রকম ‘মৃত্যুফাঁদ’-এ পরিণত হয়েছে গোটা রেলপথ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোথাও কোথায় বাঁশ দিয়ে মেরামতের চেষ্টা করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন রেল সেতু। পুরো রেলপথে প্রতি বছর ২২ লাখ ঘনফুট পাথর প্রয়োজন হলেও দেয়া হচ্ছে ১০-১২ লাখ ঘনফুট পাথর। পুরো রেলপথে পূর্ণমাত্রায় পাথর দিতে এক বছরে খরচ হয় ৩৩ কোটি টাকা। সেখানে রেলওয়ের লাইনচ্যুত বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধার এবং লাইন মেরামতে প্রতি মাসেই খরচ করছে ৮ কোটি টাকারও বেশি, যা বছরে খরচ দাঁড়ায় শত কোটি টাকায়।
রেলসূত্রে জানা যায়, লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দুপাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাটবল্টুসহ ১৬টি হুক, ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে ৫-৭টি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পয়েন্টগুলো খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। ফেটে গেছে স্লিপারগুলো। অধিকাংশ লাইনের পয়েন্ট (জোড়ারস্থল) নাটবল্টু খোলা রয়েছে। এসব পয়েন্ট দিয়ে যখন ট্রেন চলাচল করে তখন শোনা গেছে বিকট শব্দ। আবার কোথাও ফিশপ্লেট ও হুক খোলা। কোথাও কোথাও কিছু পাথর আছে, আবার কোথাও একেবারেই পাথর নেই। পাথর না থাকায় অনেক জায়গায় পানি জমে থাকায় লাইনের ক্ষতি হচ্ছে।

এ বিষয়ে একাধিক ট্রেনচালক বলেন, পাথরবিহীন লাইন আর নাটবল্টু, ক্লিপ-হুকবিহীন লাইনে ট্রেন পৌঁছতেই ঝাঁকুনি শুরু হয়। এসব স্থানেই ট্রেন সবচেয়ে বেশি লাইনচ্যুত হয়। ট্রেনের গতি বাড়ানো যায় না, অনেক সময় লাইনচ্যুতও হচ্ছে। আর দোষ হয় আমাদের।

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলপথ দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। নাটবল্টু, হুক-ক্লিপ, ফিশপ্লেট ও পাথর চুরি হচ্ছে। পুরো রেলওয়েতে প্রায় ৮০টি সেকশন রয়েছে। এসব সেকশনে রেললাইন দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন স্থায়ী রেলপথ পরিদর্শক (পিডব্লিউআই), যাদের তত্ত্বাবধানে থাকে ওয়েম্যান। ওয়েম্যানরাই মূলত লাইন রক্ষণাবেক্ষণ করেন। কিন্তু ওয়েম্যানসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। ৮ জন ওয়েম্যান একত্রিত হয়ে একটি গ্যাংক করা হয়। একেকটি গ্যাংক ৫-৮ কিলোমিটার রেলপথ প্রতিদিন দেখাশোনার কথা। বর্তমানে প্রতি গ্যাংকে ১-২ জন ওয়েম্যান রয়েছে। কোনো কোনো সেকশন গ্যাংকে ওয়েম্যানই নেই। ফলে দিনের পর দিন রক্ষণাবেক্ষণ হয় না রেললাইন।

সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯ at ১২:০৯:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/ভোকা/এএএম