রোহিঙ্গা সামলাতে বিপুল ব্যয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার চাহিদা মেটাতে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ হচ্ছে। এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, রোহিঙ্গা খাতে দুই বছরে শুধু ১৮৯টি এনজিওর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এদিকে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য একদিকে বৈদেশিক সাহায্য কমছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে নিজেদের তহবিল থেকে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।

এনজিও ব্যুরোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই বছরে এনজিওদের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। ১৮৯টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) ১ হাজার ২১টি প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করেছে এ অর্থ। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে ভরণপোষণ ব্যয়। এদিকে রোহিঙ্গা এলাকায় কাজ করতে চায় অনেক এনজিও। নতুন করে নিবন্ধন পেতে এনজিও ব্যুরোতে জমা পড়েছে শতাধিক আবেদন। তাই যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে এনজিওর সংখ্যা এবং ব্যয়ের পরিমাণ।

সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের পেছনে প্রতি বছর যে খরচ হচ্ছে তা জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা-ডব্লিউএপিএসহ বিভিন্ন বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা থেকে অনুদান পাওয়া। কিন্তু এর বাইরেও রোহিঙ্গাদের পেছনে বিপুল পরিমাণ খরচ হচ্ছে। এ ব্যয় মেটাতে হচ্ছে বাংলাদেশের বাজেট থেকে। এটি অনাকাক্সিক্ষত ব্যয়। বিশেষ করে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, নিরাপত্তাজনিত ব্যয় সরকারের তরফ থেকে খরচ করতে হচ্ছে। প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের আশ্বাস পাওয়া গেলেও দুই বছরে বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ কমছে। রোহিঙ্গা খাতের বিপুল পরিমাণ প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড়ে শুরু থেকেই বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশগুলোর সহায়তা আরো বাড়ানোর কথা জানিয়ে আসছে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বছরে রোহিঙ্গাদের ব্যয় মেটাতে খরচ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। খরচের সম্পূর্ণ অর্থ বৈদেশিক সহায়তা থেকে পাওয়া যায় না। ফলে সরকারের বাজেট থেকে খরচ করতে হয়। এতে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সেখান থেকে উত্তরণে ইউএনএইচসিআরের নেতৃত্বে একটি তহবিল করা যেতে পারে, যেখানে প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ ১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা করবে। দ্রুত সময়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়াও প্রয়োজন। অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে রোহিঙ্গা সংকটের গুরুত্ব কমে আসছে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পায়। সুতরাং এসব দেশের কাছে গুরুত্ব কমলে অর্থ সহায়তাও কমার আশঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন :
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক র‌্যালী
চোরের উপদ্রুপে অতিষ্ঠ মানুষ

সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৭ লাখ ৪৫ হাজার। এর আগে একই কারণে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৯১-৯২ ও ১৯৯৬ সালেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় শিবিরে জন্ম নিয়েছে আরো ৬০ থেকে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজারের কিছু বেশি। এদিকে ২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হতে পারে কমপক্ষে ৬০ কোটি ডলার। দুই বছরে এর পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার। যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা।

জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটে রোহিঙ্গাদের জন্য ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হয়। ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশ খাদ্য, আবাসন, স্বাস্থ্য ও অন্য জরুরি সেবাসহ আনুষঙ্গিক ভৌত সেবা সুবিধা দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী আবাসন গড়তে নোয়াখালীর ভাসানচরে আবাসন নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় ১২০টি গুচ্ছগ্রামে এক হাজার ৪৪০টি ব্যারাক ও ১২০টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। যা পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র।

এদিকে তথ্য অনুযায়ী, এনজিওর মাধ্যমে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ভরণপোষণে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৭৪৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা। এ সময় ১৩৪টি দেশি এনজিও ৬৯৬টি প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৩১৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর আন্তর্জাতিক ৫৫টি এনজিও ৩২৫টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ১ হাজার ৪৩৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। চলতি মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত ১৯টি এনজিও ২৭টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৬৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ মাসে দেশীয় ১৪টি এনজিও ২২টি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৫৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকা এবং পাঁচটি আন্তর্জাতিক এনজিও পাঁচটি প্রকল্পে ব্যয় করেছে ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা।

এনজিও ব্যুরো বলছে, এ পর্যন্ত শেল্টার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৫৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত মোট নির্মাণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ১২৭টি শেল্টার। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন থেকে পাওয়া আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণ-সংক্রান্ত একটি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার আশ্রয় ক্যাম্প। পাহাড় ও বন কেটে স্থাপন করা হয়েছে এসব আশ্রয় ক্যাম্পের অবকাঠামো। এ কারণে উজাড় হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি। এতে ৩৯৭ কোটি ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৩৯৩ টাকার সমপরিমাণ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়েছে। এদিকে বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ এর ৪/১৪ (ক)-অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোনো প্রকার অবকাঠামো বা স্থাপনা নির্মাণ করার ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশ বন বিভাগের এই আইন উপেক্ষা করে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের ৪০১ দশমিক ৪০ একর, জামতলী ও বাঘঘোনার ৫১৬ একর, বালুখালীর ৮৩৯ একর, তাজনিমা খোলার ৪৫১ একর, উখিয়ার বালুখালী ঢালা ও ময়নারঘোনার ৩১০ একর, শফিউল্লাহ কাটা এলাকার ২০১ দশমিক ২০ একর, নয়াপাড়ার ২২৪ একর, টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ের পুঁটিবুনিয়ার ৮৮ দশমিক ৬০ একর, কেরনতলী ও চাকমারকুল এলাকার ৭৯ দশমিক ৮০ একর এবং লেদারের ৪৫ একর সংরক্ষিত বনভ‚মি উজাড় করে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাসন শিবির গড়ে তোলা হয়েছে। কক্সবাজার বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় হিসাবে এই পরিমাণ জমির দাম দাঁড়ায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যা সরকারের নিজস্ব সম্পত্তি।

এনজিও ব্যুরোর তথ্য বলছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ব্যয়ের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় খাত হচ্ছে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যযন্ত্র, সেবা ও ওষুধ খাতে ব্যয় করা হয় এই অর্থ। খাদ্য সরবরাহে ব্যয় হয়েছে ১৭৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা। স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহ করে ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। কম্বলসহ শীতবস্ত্র বিতরণ হয়েছে ৮০ কোটি ৬৯ লাখ টাকার। ৯৭ কোটি ১০ লাখ টাকার বিতরণ হয়েছে হাউস হোল্ড আইটেম। এ ছাড়া স্যানিটারি ল্যাট্রিন বিতরণ করা হয়েছে ৩২ হাজার ৬৫টি, বাথরুম ১৫ হাজার ৬৬০টি এবং টিউবওয়েল নির্মাণ করা হয়েছে ২২ হাজার ৩৮৬টি।

যতই দিন যাচ্ছে চাহিদা এবং ব্যয় দুটোই বাড়ছে। এদিকে রোহিঙ্গা এলাকায় কাজ করতে চায় অনেক এনজিও। তাই যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে এনজিও সংখ্যা এবং ব্যয়ের পরিমাণ। নতুন করে নিবন্ধন পেতে এনজিও ব্যুরোতে জমা পড়েছে শতাধিক আবেদন। এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগে ছয়টি এনজিওর কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এনজিও ব্যুরো। বিশেষ করে, স্মল কাইন্ডনেস অব বাংলাদেশ, এসকেবি এবং বাংলাদেশি চাষি কল্যাণ সমিতির কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মুসলিম এইড ইউকে, ইসলামিক এইড, নমিজান ফাউন্ডেশন এবং ইসলামী রিলিফের কর্মকাণ্ড কক্সবাজার এলাকায় বন্ধ করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পুলিশের গোপন প্রতিবেদন এবং নিয়মবহির্ভূত কাজে জড়িত থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ ছাড়া ৮ থেকে ১০টি এনজিওর কর্মকাণ্ড মনিটরিং করছে এনজিও ব্যুরো।

সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯ at ১১:৪৯:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/ভোকা/এএএম