পর্দা দাম সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা, হার মানিয়েছে রূপপুরের বালিশকাণ্ডকেও

রূপপুরের বালিশকাণ্ডকে হার মানিয়ে এবার বিস্ময়কর দুর্নীতির নতুন নজির সৃষ্টি করেছে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজন রোগীকে আড়াল করার পর্দা কিনেছে সাড়ে ৩৭ লাখ টাকায়।

শুধু তাই নয়, ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যের একটি হেডকার্ডিয়াক স্টেথোসকোপের দাম দেখানো হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এ রকম ১৬৬টি যন্ত্র ক্রয়ে ৪১ কোটি ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আইসিইউতে রোগীকে আড়াল করার জন্য ব্যবহৃত একটি পর্দার দাম দেখিয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ছাড়া একটি অক্সিজেন জেনারেটিং প্ল্যান্ট কেনার খরচ দেখানো হয়েছে ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা। একটি ভ্যাকুয়াম প্ল্যান্ট ৮৭ লাখ ৫০ হাজার, একটি বিএইইস মনিটরিং প্ল্যান্ট ২৩ লাখ ৭৫ হাজার, তিনটি ডিজিটাল ব্লুাড প্রেসার মেশিন ৩০ লাখ ৭৫ হাজার এবং চারটি হেডকার্ডিয়াক স্টেথোসকোপের দাম দেখিয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

জানা গেছে, ২০১২-২০১৬ সাল পর্যন্ত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স অনিক ট্রেডার্স।

১৬৬টি যন্ত্রপাতির মোট বাজারমূল্য ১১ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা, অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিল দেখানো হয়েছে ৫২ কোটি ৬৬ লক্ষ টাকা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে মেডিকেলের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটে ঢোকার কথা ছিল বাকি ৪১ কোটি ১৩ লক্ষ টাকা।

কিন্তু দর নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় মেসার্স অনিক ট্রেডার্সের ১০ কোটি টাকার একটি বিল আটকে দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরবর্তীতে বিল পরিশোধের আবেদন জানিয়ে ২০১৭ সালে একটি রিট আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। এতে করেই বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল।

গত ২০ আগস্ট ওই রিটের শুনানিকালে হাসপাতালের কেনাকাটায় এত বড় অনিয়ম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ। সেই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি ৬ মাসের মধ্যে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সহকারী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাশার বলেন, এক রোগী থেকে আরেক রোগীকে আড়াল করার পর্দার দাম ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাজার মূল্যের সঙ্গে কোনোভাবেই এটি সঠিক মূল্য নির্ধারণ বলা যাবে না।

তিনি আরো বলেন, সরকারের যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে শুধু প্রশাসনিক নয়, আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে দুদকেও মামলা হতে পারে।

মেসার্স অনিক টেডার্সের পিটিশনার ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১-১২ সালের দিকে এই অনিক ট্রেডার্সের দুর্নীতি আর অনিয়মের বিষয়ে বেশকিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক পত্রিকাগুলোতে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রতারণার দায়ে দুদকে একটি মামলাও দায়ের করা হয়।

মন্ত্রণালয়ও এই প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল তখন। কিন্তু ২০১৩ সালে ঠিকই তারা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের এই উন্নয়ন কাজের টেন্ডার বাগিয়ে নেয়, আর এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছিলেন সরকারের সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, যিনি সেসময়ে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটায় দুর্নীতির বিষয়টি এখনো আমার নজরে আসেনি। এমন ঘটনা যদি ঘটে থাকে, যদি দুর্নীতি হয়ে থাকে; তবে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।