রাণীগঞ্জ বাজারে নির্বিচারে হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার তৎকালীন নৌবন্ধর খ্যাত রাণীগঞ্জ বাজারে নির্বিচারে হত্যা উৎসবে মেতে ওঠে পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী। ১৯৭১সনের ১সেপ্টেম্বর একাত্তরের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে জল্লাদদের আকষ্মিক গুলিবর্ষণে প্রায় দুই শতাধিক নীরিহ বাঙ্গালি শহীদ হন। তাদের রক্তে লাল হয়েছিল কুশিয়ারা নদীর জল।
সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ভয়ঙ্কর রাণীগঞ্জ গণহত্যা দিবসটি পালন উপলক্ষে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনতা আলোচনা সভার আয়োজন করেছেন।  সকালে বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নির্মিত শহীদ স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধায় সাথে শহীদদের স্মরণ করেন এলাকাবাসী।
এই নৃশংসতার আরেক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান,দুপুরে বাজারে এসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা শুরু করে। মানুষ প্রাণ বাচাতে দিকবিদিক ছুটোছুটি করে। অনেকে ঝাপিয়ে পড়েন কুশিয়ারা নদীতে। তারপরও তারা বাচতে পারেননি। তাদেরকেও গুলি করা হয়। মানুষের রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল কশিয়ারা নদীর জল। হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার সময় বাজারে কেরোসিনের দোকানের কয়েকটি ড্রামের তেল ফেলে দিয়ে পুরো বাজার জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। নির্বিচার গুলিবর্ষণ থেকে বাচতে অনেক মানুষ কুশিয়ারা নদীতে।
তিনি বলেন,পরবর্তীতে কুশিয়ারা নদী হয়ে ভেসে যাওয়া গণহত্যায় নিহতের লাশ কাক শকুনে খায়। হানাদারদের ভয়ে মানুষ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় অনেকেরই লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ গণহত্যার খবর তখন নয়াদিল্লী থেকে বিসিসিতে প্রচার হয়েছিল বলে তিনি জানান। বিভিষীকাময় এই দিনটির কথা মনে করে এখনো প্রত্যক্ষদর্শীরা নিরবে কাঁদেন।
আরো জানাযায়,মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে কোন নান্দনিক স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। শহীদদের স্মরণে স্মৃতি সংরক্ষণ ও গণহত্যাস্থল চিহ্নিত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। দায়সারাভাবে রাণীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যবর্তী শহীদ মিনার সংলগ্ন একটি স্মৃতি ফলক প্রতীক হিসেবে গণহত্যার স্মৃতি স্মরণ করছে।
জানা গেছে জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ ১৯৯৪ সনে একটি ফলক নির্মাণ করে সেখানে ৩৪ জন শহীদ ও আহত তিনজনের নাম ফলকে লিখে দেয়। এই ফলকটিও অরক্ষিত। কোন পরিচর্চার উদ্যোগ নেই।
রাণীগঞ্জ গণহত্যায় আহত বাজারের ব্যবসায়ী মজম্মিল মিয়া (৭০) জানান,১৯৭১ সনের ১ সেপ্টেম্বর দুপুরে সাড়ে ১২টায় হবিবপুর গ্রামের রাজাকার রেজাক মিয়া ও এহিয়া পাক হানাদারদের রাণীগঞ্জ বাজারে নিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধাদের সহায়তার অভিযোগে বাজারে আগত দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীদের তার দোকানে ডেকে জড়ো করে আনার পর পাক বাহিনী নির্বিচারে ব্রাশফায়ার হত্যা করে অন্তত দুইশত মানুষকে। এর মধ্যে কয়েকদিন পরে এসে স্থানীয় মানুষ মাত্র শহীদ ৩৪ জনকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি পিটে ও উড়ুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে একটি পা হারিয়ে বাথরুসে আশ্রয় নিয়ে কোন রকম বেঁচে গিয়েছিলেন। অধিকাংশ শহীদের লাশ বর্ষার পানিতে কুশিয়ারা হয়ে ভেসে যায় বলে তিনি জানান।
জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মুক্তাদীর আহমদ বলেন,সুনামগঞ্জ জেলার সবচেয়ে নারকীয় গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল রাণীগঞ্জ বাজারে। ইতিহাসের এই বিভিষীকাময় ঘটনায় শহীদদের স্মরণে দায়সারা ফলক তৈরি হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এলাকাবাসীর এই ত্যাগের কথা জানেনা দেশবাসী। শহীদদের স্মরণ ও স্মৃতিরক্ষায় এখনো কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমি দায়িত্বে থাকার সময় সরকারিভাবে কয়েকটি কর্মসূচি করেছিলাম। এলাকার তরুণদের নিয়ে স্মৃতিরক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছিলাম।
সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯ at ১৬:৩৭:৩০ (GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আক/জেএ/কেএ