চৌগাছায় ভিজিএফের চাল নিলেন ধনাঢ্যরাসহ প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিরা

চার হাজার চারশত তিপ্পান্ন কেজি চাল কোথায় গেলো?

যশোরের চৌগাছায় ভিজিএফের চাল বিতরনে উঠে আসছে নানা অনিয়মের ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ। সরকারি বস্তায় চাল কম থাকা শুরু করে তালিকা প্রনয়ন এমনকি বিতরনের সময় চাল কম দেওয়া ছাড়াও রয়েছে অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগও।

জানাযায়, প্রতি ঈদের আগে দেশের গরীব অসহায় জনগনের মুখে হাসি ফোটাতেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার এই ভিজিএফের চাল। সেই চাল পৌরসভা থেকে শুরু করে ইউনিয়নের মাধ্যমে গরীব অসহায়দের মাঝে বিতরন করার নিয়ম রয়েছে। কিন্ত এই চাল খাদ্যগুদাম থেকে সরবারহ ও বিতরনের তালিকা প্রনয়নে যে অনিয়ম রয়েছে তা রীতিমতো আৎকে উঠার মতো।

জানাযায়, ইউনিয়ন প্রতি সরকারের বরাদ্দকৃত চাল খাদ্যগুদাম থেকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যখন বুঝেনেন সেখানেই থাকে প্রধান অসঙ্গতি। বরাদ্দকৃত চাল ৫০ কেজি ও ৩০ কেজির বস্তায় খাদ্যগুদাম থেকে সরবরাহ করা হয়। সেই চাল ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে ওজন দিলে দেখা যায় বস্তায় লিখিত ওজনের চেয়ে ৫০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত চাল কম আছে।

এবারের ঈদে চৌগাছা উপজেলায় ১১ টি ইউনিয়ন ও ১ টি পৌরসভায় গরীব অসহায়দের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহার ছিল মোট ৭ শ ৪৭ মেট্রিক টন ২ শ ৩০ কেজি চাল। সে হিসেবে ৫০ কেজি চালের বস্তা ছিল ৪ হাজার ৮৬ টি এবং ৩০ কেজির বস্তা ছিল ১১ হাজার ১ শ ৮১টি।

ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের বক্তব্য অনুযায়ি প্রতিটি বস্তায় দু‘শ থেকে পাঁচশত গ্রাম পর্যন্ত চাল কম থাকে। সে হিসেবে এবার উপজেলাতে মোট ৪ হাজার ৪ শ ৫৩ কেজি চারশত গ্রাম চাল কম বিতরন হয়েছে। যদি চালের দাম ২৫ টাকা কেজিও ধরা হয় তবে ১ লক্ষ ১১ হাজার ৩ শত ৩৫ টাকার চাল খাদ্যগুদামে থেকে গেছে। যদি পাঁচশ গ্রাম বা তার অধিক পরিমান চাল বস্তায় কম থাকে তাহলে সে সংখ্যাটি এবং মূল্য আরো বেশি হয়ে যায়।

চাল কম থাকার কারন হিসেবে উপজেলা খাদ্যগুদামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কার্তিক বলেন, প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তার প্রাপ্য চাল ঠিকমতো বুঝে নিয়ে যান। আপনারা যখন সরকারি ভাবে চাল সংগ্রহ করেন তখন কি ওজনে কম থাকে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তেমন কোনো সুযোগ নেই। তাহলে বস্তায় চাল কম থাকে কেনো প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু’একশ গ্রাম চাল লোড আনলোডের সময় কম হতে পারে। কিন্তু এর বেশি কম হয়না। অথচ ঈদের আগে চৌগাছার ১ নং ফুলসারা ইউনিয়নে চাল বিতরনের সময় সরজমিনে দেখা যায় প্রতি ৩০ কেজির বস্তায় চাল আছে ২৮ থেকে সাড়ে আঠাশ কেজি পর্যন্ত।

এর কারন জানতে চাইলে খাদ্যগুদাম কর্মকর্তা বলেন, এমন অভিযোগ পেয়ে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। আমার উপাস্থিতিতে তারা আবার চাল মেপেছে। আমি ডিজিটাল মেশিনে চাল মাপিয়ে তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছি। চাল কমছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুশ থেকে পাঁচশ গ্রাম বস্তায় কম আছে।

আরো পড়ুন:
চৌগাছায় ডেঙ্গুর সাথে ডায়রিয়া রোগীর প্রকোপ বেড়েই চলেছে
বিয়ের দাবীতে দুদিন যাবৎ অনশন করছে যুবতী

বিষয়টি সম্বন্ধে জানতে চাইলে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মেহেদী মাসুদ চৌধূরী বলেন, চাল মেপে কম পাওয়ার পরে আমি খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাকে ফোন করি। তখন তিনি আমাকে পুনরায় সেই সমপরিমান চাল পৌছে দেন।

ছবি: ভিজিএফের চালের তালিকাভূক্ত জাপান প্রবাসী আছির উদ্দিনের বাড়ি।

স্বরুপদাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার শেখ জানান, বস্তায় দু‘শত গ্রাম থেকে পাঁচশত গ্রাম পর্যন্ত চাল কম পাওয়া যায়। সেই চাল কোথায় যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইনত বলতে গেলে সেটা খাদ্যগুদামেই থাকে।

ইউনিয়ন পরিষদের নামের তালিকায়ও রয়েছে ঘাপলা। স্থানীয় ইউপি সদস্যরা তাদের কাছের লোকজন এবং আত্নীয় স্বজনদের নাম প্রথমেই তালিকাভূক্ত করেন। এরপরে তারা এমন মানুষের নাম তালিকায় উঠান যারা সেই চাল নিতে আসে না। সেই নামের মধ্যে প্রবাসি, স্থানীয় ধর্নাঢ্য ব্যক্তি এমনকি মৃত মানুষের নামও থাকে। তাদের নামের সেই চাল উত্তোলন করে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বররাই আত্নসাৎ করেন।

তারা সেই এক শ্রেনীর ব্যবসায়ীদের কাছে অবৈধভাবে বিক্রি করে দেন। গরীব অসহায়দের বাইরে তাদের পছন্দের বিভিন্ন মানুষকে সেই চাল উত্তোলন করে বস্তায় ভরে বিক্রি করতে দেখা যায়। আবার অনেক ক্রেতাকে ইউনিয়ন পরিষদের কাছেই ডিজিটাল মেশিনে মেপে কেজি প্রতি ১৬ থেকে ১৮ টাকা দরে কিনতে দেখা যায়।

ইউনিয়নরে এই ভিজিএফের নামের তালিকা যাচাই বাছাই করেন উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে চৌগাছা উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ইশতিয়াক জানালেন, ভিজিএফের তালিকা চেয়ারম্যানরা দিলে সেটা যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব আমাদের। সেটা করা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, মোটামুটি করা হয়। তাহলে সেখানে ধর্নাঢ্য আর মৃত ব্যক্তিদের নাম কিভাবে আসে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তেমনি উপজেলার নরায়নপুর ইউনিয়নে ভিজিএফের চাল বিতরনের অনিয়ম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

আরো পড়ুন:
পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষনের অভিযোগ
রানার সম্পাদক মুকুলের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে জেইউজে’র নানা কর্মসূচি গ্রহণ

প্রসঙ্গত, এবারে ভিজিএফের চালের তালিকায় নাম রয়েছে অষ্ট্রেলিয়া ও জাপান প্রবাসীদের। এছাড়াও, মৃত ব্যক্তিদের নামেও কার্ড থাকায় তাদের পরিবারও চাল নিয়েছেন। গত রবিবার এসব ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মাঝে চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ঘটনাটি ঘটেছে চৌগাছার নারায়নপুর ইউনিয়নে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চৌগাছা উপজেলার নারায়রপুর ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের তিন গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার ভিজিএফ এর চাল গত ঈদ উল আযহার আগে বিতরণ হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর গত রবিবার ওই ওয়ার্ডের ৮ শ ৩০ পরিবারের মধ্যে ভিজিএফের চাল বিতরণ করা হয়।

বিতরণকৃতদের তালিকায় নাম রয়েছে নারায়ণপুর গ্রামের মৃত জালাল মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলামের। তিনি নারায়নপুর বাজারে তিনতলা একটি ভবনের মালিক। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের নারায়ণপুর শাখা অফিস রয়েছে।

নারায়ণপুর গ্রামের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি অষ্টলিয়া প্রবাসী রুবেল হোসেন এবং জাপান প্রবাসী আছির উদ্দীন মৃধা। দু’জনেরই রয়েছে গ্রামে দৃষ্টিনন্দন বহুতল বাড়ি।

একইভাবে গ্রামের মৃত নুর আলী মুন্সির ছেলে সামসুল মুন্সি, মোবারক সর্দারের ছেলে মনিরুল ইসলামের রয়েছে গ্রামে দৃষ্টি নন্দন বাড়ি। তারা সকলেই রবিবার ভিজিএফের চাল নেয়ার তালিকায় ছিলেন।

তাদের সকলের বাড়িতে ভিজিএফের চাল উত্তোলনের টোকেন পৌঁছেদেন ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী সদস্য রাবেয়া খাতুন।

তবে কার্ডধারী এসকল পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিজেরাই জানেন না তারা ভিজিএফের চালের কার্ডধারী।

তারা জানান, ২৫ জুলাই উপ-নির্বাচনে বিজয়ী ইউপি সদস্য ইউসূফ আলী সাবেক ইউপি সদস্যের করা ভিজিএফএর তালিকা নিয়ে আপত্তি জানালে ঈদের আগে চাল বিতরণ বন্ধ করে দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)।

সাবেক ও বর্তমান ইউপি সদস্যের সমর্থকদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এলে তারা জানতে পারেন স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের নামেও ভিজিএফের কার্ড ইস্যু করা হয়েছে।

তালিকায় থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি জানিয়েছেন, আমরা এর আগে কখনো চাল গ্রহণ করিনি। অথচ পূর্বের তালিকায়ও আমাদের নাম রয়েছে। তবে রবিবার পরিষদে বিতরণকৃত চাল এসব ব্যক্তির কয়েকজন গ্রহণ করে দরিদ্রদের দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, পূর্বের ওই তালিকার অন্ততঃ ষাটভাগ সদস্য ধনি পরিবারের। তাদের বেশিরভাগই জানেন না তাদের নামে ভিজিএফ কার্ড রয়েছে। ওই চাল তুলে আত্মসাৎ করেন নারী ইউপি সদস্য রাবেয়া খাতুন।

তাদের আরও অভিযোগ তালিকায় থাকা নারায়ণপুর গ্রামের মৃত বায়োজিদ সর্দারের ছেলে মোমিনুর রহমান ছয় বছর আগে মারা গেছেন। একই গ্রামের মৃত ওহেদ আলীর ছেলে আব্দুল হালিম দুই বছর আগে মারা গেছেন। তালিকায় তাদের নাম থাকায় গ্রামের লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তারা বলছেন, নতুন মেম্বার তো এসব অসঙ্গতি তুলে ধরেছেন। তবুও পুরনো তালিকায় কেন চাল বিতরণ করা হলো ?

গ্রামের তুহিনুর রহমান তুহিন ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি। তিনি চৌগাছা বাজারে ব্যবসা করেন। বিগত ইউপি নির্বাচনে তিনি চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন। তার নামেও রয়েছে ভিজিএফএর চালের কার্ড।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নাম যে তালিকায় রয়েছে এবারই প্রথম জানলাম। অথচ এতদিন আমার নামে চাল উঠে যাচ্ছে। তিনি এসব অনিয়মের সাথে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।

একই গ্রামের মিজানুর রহমান, বাবর আলী, আমিনুর রহমান, শাহিনুর রহমান সকলেই এলাকায় অবস্থাশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। তাদের সকলের দাবি তারা নিজেরাও জানেননা তাদের নামে ভিজিএফের এসব চাল উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে ইউপি চেয়াম্যান জয়নাল আবেদীন মুকুল বলেন, মৃত সাবেক ইউপি সদস্যের তালিকা অনুসরণ করে চালের স্লিপ করা হয়েছিল। তবে বিষয়টি প্রকাশ পেলে অনেক ধনি ব্যক্তি চাল নিতে আসেনি। সেই চাল আমরা দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করেছি।

আগস্ট ২৬, ২০১৯ at ২৩:১২:৫৬(GMT+06)
দেশদর্পণ/আহা/আকে/জিআররি/আজা